ঢাকা ০৩:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

    ডলারের বিকল্প খুঁজছে বিশ্ব: সোনায় ঝুঁকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো

    নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
    • আপডেট সময় ০১:৩৫:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
    • / ২৬৬ বার পড়া হয়েছে

    বিশ্ববাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকায় বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই প্রবণতা আরও জোরালো হয়েছে। এখন অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে সোনার প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে এবং ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর কৌশল গ্রহণ করছে।

    ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) সাম্প্রতিক “সেন্ট্রাল ব্যাংক গোল্ড রিজার্ভ সার্ভে ২০২৫”–এ দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামীতে তাদের স্বর্ণ ভান্ডার বাড়াতে আগ্রহী। একইসঙ্গে, জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের কোষাগারে আগামী ১২ মাসের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সোনা সংরক্ষিত আছে।

    এই প্রবণতার মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডলারকে অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখন থেকেই অনেক দেশ ডলারের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন বিকল্প হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

    মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইনভেস্টর ডট কম জানিয়েছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা সোনার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৬ হাজার ২০০ টন, যা সরকারি রিজার্ভের প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালের শুরুতে এই হার ছিল ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছে, চলতি বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ৯০০ টন সোনা কিনতে পারে।

    বিশ্লেষকদের মতে, ডলারের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করাই এখন অনেক দেশের প্রধান লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী আর্থিক কৌশল গ্রহণ করা দেশগুলোর মধ্যে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো অগ্রগণ্য। এই দেশগুলো একদিকে যেমন বিকল্প বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থার কথা ভাবছে, অন্যদিকে তারা সবাই সোনার বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে।

    বিশেষত চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (পিপলস ব্যাংক অব চায়না) টানা সাত মাস ধরে সোনা কিনে তাদের রিজার্ভ বাড়িয়ে চলেছে। মে মাসে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.২৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা তাদের আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চলতি বছর সোনার দাম বেশ চড়া থাকলেও চীন সোনা কেনা বন্ধ করেনি। বরং উচ্চ দামে সত্ত্বেও তারা যে সোনা সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে, তা থেকে বোঝা যায়—ডলার নির্ভরতা কমাতে তারা কতটা তড়িঘড়ি করছে।

    এই প্রবণতার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে চীনের বিনিয়োগ হ্রাসে। ফেব্রুয়ারিতে চীনের হাতে থাকা মার্কিন ঋণপত্রের পরিমাণ ছিল ৭৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিলের শেষে এসে কমে দাঁড়ায় ৭৫৭ বিলিয়নে। দুই মাসে কমেছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন ডলার-নির্ভর সম্পদের পরিবর্তে সোনাকে বেশি নিরাপদ মনে করছে।

    ডব্লিউজিসির তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ৪৭ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় ও ছোট উভয় ধরনের খনি থেকে সোনা সংগ্রহ করছে। তাদের মধ্যে বড় খনিগুলোর মাধ্যমে সোনার সরবরাহের হার ৩৭ শতাংশ এবং ছোট খনিগুলোর ক্ষেত্রে তা ১৬ শতাংশ। বাকি অংশ তারা বাজার থেকে সংগ্রহ করে থাকে, যদিও দেশভেদে এই অনুপাত কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে।

    চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দাম সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়ে যায়। তখন এক আউন্স সোনার দাম ওঠে ৩,৫০০ ডলারে। আজকের বাজারে সোনার মূল্য কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,২৫০ ডলার প্রতি আউন্সে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন—যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা অব্যাহত রাখে, তবে আগামী মাসগুলোতে সোনার দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।

    বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েন এবং আর্থিক ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তার কারণে সোনার প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর এই ঝোঁক আগামীতে আরও বাড়বে বলেই ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এটি শুধু আর্থিক কৌশলের পরিবর্তন নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে এক নতুন মোড় বলে মনে করছেন অনেকেই।

    নিউজটি শেয়ার করুন

    ডলারের বিকল্প খুঁজছে বিশ্ব: সোনায় ঝুঁকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো

    আপডেট সময় ০১:৩৫:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

    বিশ্ববাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকায় বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই প্রবণতা আরও জোরালো হয়েছে। এখন অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে সোনার প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে এবং ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর কৌশল গ্রহণ করছে।

    ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) সাম্প্রতিক “সেন্ট্রাল ব্যাংক গোল্ড রিজার্ভ সার্ভে ২০২৫”–এ দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামীতে তাদের স্বর্ণ ভান্ডার বাড়াতে আগ্রহী। একইসঙ্গে, জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের কোষাগারে আগামী ১২ মাসের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সোনা সংরক্ষিত আছে।

    এই প্রবণতার মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডলারকে অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখন থেকেই অনেক দেশ ডলারের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন বিকল্প হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

    মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইনভেস্টর ডট কম জানিয়েছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা সোনার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৬ হাজার ২০০ টন, যা সরকারি রিজার্ভের প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালের শুরুতে এই হার ছিল ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছে, চলতি বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ৯০০ টন সোনা কিনতে পারে।

    বিশ্লেষকদের মতে, ডলারের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করাই এখন অনেক দেশের প্রধান লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী আর্থিক কৌশল গ্রহণ করা দেশগুলোর মধ্যে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো অগ্রগণ্য। এই দেশগুলো একদিকে যেমন বিকল্প বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থার কথা ভাবছে, অন্যদিকে তারা সবাই সোনার বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে।

    বিশেষত চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (পিপলস ব্যাংক অব চায়না) টানা সাত মাস ধরে সোনা কিনে তাদের রিজার্ভ বাড়িয়ে চলেছে। মে মাসে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.২৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা তাদের আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চলতি বছর সোনার দাম বেশ চড়া থাকলেও চীন সোনা কেনা বন্ধ করেনি। বরং উচ্চ দামে সত্ত্বেও তারা যে সোনা সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে, তা থেকে বোঝা যায়—ডলার নির্ভরতা কমাতে তারা কতটা তড়িঘড়ি করছে।

    এই প্রবণতার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে চীনের বিনিয়োগ হ্রাসে। ফেব্রুয়ারিতে চীনের হাতে থাকা মার্কিন ঋণপত্রের পরিমাণ ছিল ৭৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিলের শেষে এসে কমে দাঁড়ায় ৭৫৭ বিলিয়নে। দুই মাসে কমেছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন ডলার-নির্ভর সম্পদের পরিবর্তে সোনাকে বেশি নিরাপদ মনে করছে।

    ডব্লিউজিসির তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ৪৭ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় ও ছোট উভয় ধরনের খনি থেকে সোনা সংগ্রহ করছে। তাদের মধ্যে বড় খনিগুলোর মাধ্যমে সোনার সরবরাহের হার ৩৭ শতাংশ এবং ছোট খনিগুলোর ক্ষেত্রে তা ১৬ শতাংশ। বাকি অংশ তারা বাজার থেকে সংগ্রহ করে থাকে, যদিও দেশভেদে এই অনুপাত কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে।

    চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দাম সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়ে যায়। তখন এক আউন্স সোনার দাম ওঠে ৩,৫০০ ডলারে। আজকের বাজারে সোনার মূল্য কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,২৫০ ডলার প্রতি আউন্সে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন—যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা অব্যাহত রাখে, তবে আগামী মাসগুলোতে সোনার দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।

    বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েন এবং আর্থিক ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তার কারণে সোনার প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর এই ঝোঁক আগামীতে আরও বাড়বে বলেই ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এটি শুধু আর্থিক কৌশলের পরিবর্তন নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে এক নতুন মোড় বলে মনে করছেন অনেকেই।