ঢাকা ০৯:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

    বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেপালের আন্দোলনকে তুলনা করল ইন্ডিয়া টুডে

    আন্তর্জাতিক ডেস্ক
    • আপডেট সময় ০৫:৫৭:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
    • / ২৭৭ বার পড়া হয়েছে

    দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে গত তিন বছরে একের পর এক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট, পাকিস্তানে ইমরান খানের পতন থেকে শুরু করে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের বিদায়—সব ক্ষেত্রেই এক পরিচিত দৃশ্য দেখা গেছে গণবিক্ষোভে সরকারের পতন। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো নেপাল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারির পর শুরু হওয়া আন্দোলনে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২২ জন।

    প্রথমে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নামলেও দ্রুতই আন্দোলন রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী গণবিক্ষোভে। একপর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ও রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেল। সূত্রমতে, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অলি দেশ ছেড়ে দুবাই পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

    রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীরা ‘কেপি চোর, দেশ ছাড়’ স্লোগান দিতে দিতে তাণ্ডব চালায়। অলি, রাষ্ট্রপতি পাওডেল এবং মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজনের ব্যক্তিগত বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রেহাই পায়নি সরকারি দলের নেতাদের মালিকানাধীন স্থাপনাও। কাঠমান্ডুর বিখ্যাত হিলটন হোটেল, যা শাসক দলের এক নেতার মালিকানাধীন, সেটিও বিক্ষোভকারীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

    ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশেও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। প্রথমে অর্থনৈতিক সংকট বা নির্বাচনী বিতর্ককে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। জনরোষে ঘেরাও হয় রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের বাড়ি। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে যান মালদ্বীপে, আর বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন ভারতে। এখন সেই একই দৃশ্য পুনরায় দেখা গেল নেপালে।

    ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর থেকে নেপালে একের পর এক সরকার পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। গত ১৭ বছরে দেশটিতে গঠিত হয়েছে ১৪টি সরকার, যার অধিকাংশই ছিল জোট সরকার। দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বেকারত্বে জর্জরিত হয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে তরুণ প্রজন্ম। এর মধ্যেই রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে শুরু হয় ‘নেপো কিড’ আন্দোলন, যা সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষকে আরও উসকে দেয়।

    অলি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে তার পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকেও। চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তিনি প্রথম বিদেশ সফরে যান বেইজিংয়ে, যা নেপালি নেতাদের প্রচলিত ভারত সফরের রীতি ভেঙে দেয়। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিয়ে নেপাল পায় ৪১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা, যা দেশটিকে আরও গভীরভাবে চীনের প্রভাবে টেনে আনে।

    চীনের প্রভাব বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রও নেপালে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্প প্রশাসন দেশটিকে ফিরিয়ে আনে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কমপ্যাক্ট’ প্রকল্পে। এরপর থেকে নেপালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করে। অলি চীনের বিজয় দিবস প্যারেডে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাকে মার্কিনবিরোধী শিবিরের একজন নেতারূপে দেখা হতে থাকে।

    এই প্রেক্ষাপটে অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের মতো নেপালেও যুক্তরাষ্ট্র পর্দার আড়াল থেকে পরিবর্তনের খেলায় নেমেছে। বিশ্লেষক এসএল কান্তনের ভাষায়, “এটি শতভাগ মার্কিন প্রভাবিত বিপ্লব।”

    অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি চীন-আমেরিকার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নেপালের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—নেপাল কি দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি নতুন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো?

    নিউজটি শেয়ার করুন

    বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেপালের আন্দোলনকে তুলনা করল ইন্ডিয়া টুডে

    আপডেট সময় ০৫:৫৭:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

    দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে গত তিন বছরে একের পর এক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট, পাকিস্তানে ইমরান খানের পতন থেকে শুরু করে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের বিদায়—সব ক্ষেত্রেই এক পরিচিত দৃশ্য দেখা গেছে গণবিক্ষোভে সরকারের পতন। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো নেপাল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারির পর শুরু হওয়া আন্দোলনে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২২ জন।

    প্রথমে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নামলেও দ্রুতই আন্দোলন রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী গণবিক্ষোভে। একপর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ও রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেল। সূত্রমতে, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অলি দেশ ছেড়ে দুবাই পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

    রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীরা ‘কেপি চোর, দেশ ছাড়’ স্লোগান দিতে দিতে তাণ্ডব চালায়। অলি, রাষ্ট্রপতি পাওডেল এবং মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজনের ব্যক্তিগত বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রেহাই পায়নি সরকারি দলের নেতাদের মালিকানাধীন স্থাপনাও। কাঠমান্ডুর বিখ্যাত হিলটন হোটেল, যা শাসক দলের এক নেতার মালিকানাধীন, সেটিও বিক্ষোভকারীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

    ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশেও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। প্রথমে অর্থনৈতিক সংকট বা নির্বাচনী বিতর্ককে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। জনরোষে ঘেরাও হয় রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের বাড়ি। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে যান মালদ্বীপে, আর বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন ভারতে। এখন সেই একই দৃশ্য পুনরায় দেখা গেল নেপালে।

    ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর থেকে নেপালে একের পর এক সরকার পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। গত ১৭ বছরে দেশটিতে গঠিত হয়েছে ১৪টি সরকার, যার অধিকাংশই ছিল জোট সরকার। দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বেকারত্বে জর্জরিত হয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে তরুণ প্রজন্ম। এর মধ্যেই রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে শুরু হয় ‘নেপো কিড’ আন্দোলন, যা সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষকে আরও উসকে দেয়।

    অলি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে তার পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকেও। চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তিনি প্রথম বিদেশ সফরে যান বেইজিংয়ে, যা নেপালি নেতাদের প্রচলিত ভারত সফরের রীতি ভেঙে দেয়। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিয়ে নেপাল পায় ৪১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা, যা দেশটিকে আরও গভীরভাবে চীনের প্রভাবে টেনে আনে।

    চীনের প্রভাব বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রও নেপালে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্প প্রশাসন দেশটিকে ফিরিয়ে আনে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কমপ্যাক্ট’ প্রকল্পে। এরপর থেকে নেপালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করে। অলি চীনের বিজয় দিবস প্যারেডে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাকে মার্কিনবিরোধী শিবিরের একজন নেতারূপে দেখা হতে থাকে।

    এই প্রেক্ষাপটে অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের মতো নেপালেও যুক্তরাষ্ট্র পর্দার আড়াল থেকে পরিবর্তনের খেলায় নেমেছে। বিশ্লেষক এসএল কান্তনের ভাষায়, “এটি শতভাগ মার্কিন প্রভাবিত বিপ্লব।”

    অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি চীন-আমেরিকার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নেপালের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—নেপাল কি দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি নতুন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো?