কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার পতনের ইতিহাস-৫আগস্ট ২০২৪

- আপডেট সময় ০২:৪৯:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫
- / ২৫৮ বার পড়া হয়েছে
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের দিনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে সূচিত হওয়া একটি ছাত্র আন্দোলন কীভাবে সরকারের পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই দিনটি। ‘এক দফা, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ স্লোগান ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এর পেছনের ঘটনা পরম্পরা ছিল দীর্ঘমেয়াদী, গভীর এবং বহুস্তরীয়।
এক দফা দাবিতে উত্তরণ: কোটা সংস্কারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গণআন্দোলন
নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের প্রতি ন্যায়বিচারের দাবিতে এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ একপর্যায়ে নতুন রূপ নেয়। শুরুতে কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে কেন্দ্রিত আন্দোলনটি অল্প সময়ের মধ্যেই রূপ নেয় সর্বাত্মক সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে। “আর কোনো কথা নয়, এক দফা—শেখ হাসিনার পদত্যাগ” এই স্লোগানটি হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রাণ। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক: অচল হয়ে পড়ে অর্থনীতি ও প্রশাসন
আন্দোলনকারীরা সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানায়। তারা কর ও বিল পরিশোধ বন্ধ, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। এই অসহযোগ কর্মসূচি দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং দেশের কার্যকর কাঠামো প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
সরকারের পতনের অন্তর্নিহিত কারণসমূহ
যদিও কোটা সংস্কার আন্দোলনই এই গণজাগরণের সূচনা ঘটায়, এর পেছনে বহুদিনের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ ও কাঠামোগত ব্যর্থতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথমত, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। মেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, কমিশন বাণিজ্য এবং রাষ্ট্রীয় অর্থপাচারসহ নানা ইস্যুতে জনমনে তীব্র ক্ষোভ জন্ম নেয়। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাব সরকারবিরোধী মনোভাবকে গভীর করে তোলে।
দ্বিতীয়ত, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট এবং বেকারত্ব—বিশেষত তরুণ সমাজের হতাশা আন্দোলনের ভিত্তিকে শক্তিশালী করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
তৃতীয়ত, গণতান্ত্রিক চর্চার সংকোচন এবং ভিন্নমতের দমনও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ কঠোর আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়। গণমাধ্যমের ওপরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে দুর্বল করে তোলে।
চতুর্থত, পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের সহিংস দমননীতিও জনরোষকে বাড়িয়ে তোলে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলিবর্ষণ, লাঠিপেটা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষ হতাহত হয়।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: আত্মঘাতী পদক্ষেপের পরিণতি
আন্দোলনের সূচনায় সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ষড়যন্ত্রের অংশ বলে আখ্যায়িত করে। এই মনোভাব সাধারণ মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। পরবর্তীতে সরকার আন্দোলন দমন করতে শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে আন্দোলনকারীদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়, যার ফলে তথ্যপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে এবং পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়। বিভিন্ন জেলায় কারফিউ জারি করা হলেও জনগণের ক্ষোভ এতটাই চরমে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তা আর আটকানো সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের এই দমননীতি ব্যুমেরাং হয়ে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে।
৫ আগস্ট: ঢাকার রাজপথে জনস্রোত ও গণভবন অভিমুখে অভিযান
৫ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকার রাজপথে লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয়। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানীতে এসে গণভবন অভিমুখে অগ্রসর হয়। সবরকম বাধা উপেক্ষা করে তারা গণভবনের চারপাশ ঘিরে ফেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে জানা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তিনি তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারত চলে যান। একটানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারের এই আকস্মিক পতন গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করে।
নিরাপত্তা বাহিনীর বিতর্কিত ভূমিকা ও সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থান
আন্দোলনের প্রথম দিকে পুলিশ ও র্যাব টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং সরাসরি গুলি চালিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আন্দোলন যত বড় হয়, তত বেশি র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা জনগণের ক্ষোভের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সেনাবাহিনী শুরুতে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে এবং পরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এটি সরকারের পতনের পথে গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করে।
গণহত্যা ও জবাবদিহিতার দাবি
আন্দোলনের সময় নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং আহত হন শত শত মানুষ। এই ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে পরবর্তীতে শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়ের করা হয়।
বিজয়ের আনন্দ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উত্থান
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সারা দেশে উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বিজয়ের আনন্দে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আনন্দমিছিল, মিষ্টি বিতরণ এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষ মুক্তির আনন্দ উদযাপন করে। এরপর সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে।
৫ আগস্টের পরবর্তী বাংলাদেশ: নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ এক নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রবেশ করে। বড় ধরনের সহিংসতা না থাকলেও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনে মনোযোগী হয় এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালায়। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যার অভিযোগে মামলা হয়। কেউ গ্রেপ্তার হন, কেউ পালিয়ে যান। দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয় এবং বহু লুটপাটের চিত্র প্রকাশ্যে আসে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ বার্তা
বাংলাদেশের এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। বিশ্ব সম্প্রদায় বিষয়টিকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে এবং একটি গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কেবল একটি সরকারের পতন ছিল না, বরং এটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ।
এই দিনটি প্রমাণ করে যে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি যেকোনো স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করতে সক্ষম। এই আন্দোলন ও পতন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।