চলে গেল মাহেরীন, রেখে গেল অগোছালো সংসার, : স্বামী মনসুর হেলাল

- আপডেট সময় ১২:৫১:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
- / ২৫৮ বার পড়া হয়েছে
উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করতেন মাহেরীন চৌধুরী। গত ২১ জুলাই হায়দার আলী ভবনে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকাণ্ডে তিনি প্রাণ হারান। অথচ এর কিছুদিন আগেই, ৬ জুন ছিল তাঁর জন্মদিন। বড় ছেলে আয়ান রশিদ মাকে নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে একটি ব্যাগ কিনে দিয়েছিল। সেই ব্যাগ অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু মাহেরীন ফিরেছেন না ফেরার দেশে।
স্কুল ভবনে বিমান বিধ্বস্তের পর যখন চারদিকে আগুন ও আতঙ্ক, তখন ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাহেরীন। শিশুশিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই মারাত্মক দগ্ধ হন। পরে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন, আর সেখানেই শেষ হয় তাঁর ১৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনের অধ্যায়।
মাহেরীন ছিলেন বাংলা মাধ্যমের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর। তাঁর স্বামী মো. মনসুর হেলাল জানান, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় মাহেরীন বলেছিলেন, “স্কুলের বাচ্চারাও তো আমার সন্তান।” এমন অসামান্য মানবিকতা আজও বিদীর্ণ করে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হৃদয়।
মনসুর ও মাহেরীনের সংসার ছিল সহজ-সরল, অথচ পরিপূর্ণ। দুজনের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল বন্ধুত্ব দিয়ে, পরে তা গড়ায় ভালোবাসা ও সংসারে। তাঁরা দুই ছেলের বাবা-মা—নবম শ্রেণির ছাত্র আদিল এবং ও লেভেল পড়ুয়া আয়ান। মাহেরীন ছেলেদের যত্নে নিজের পুরোটা ঢেলে দিতেন। সন্তানদের পড়ালেখা থেকে শুরু করে আদবকেতা, সবকিছুতে ছিলেন পরিপাটি ও দায়িত্বশীল।
মাহেরীনের মৃত্যুর পর মনসুর বলেন, এখন শুধু সংসার নয়, তাঁদের পুরো জীবনটাই হয়ে গেছে অগোছালো। কারণ যিনি সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন, তিনিই এখন নেই। মাহেরীনের ছোট ভাই জানান, তাঁদের পরিবারে বড় বোনই ছিলেন অভিভাবকস্বরূপ। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সব উৎসব-অনুষ্ঠান তাঁকে ঘিরেই হতো। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর শূন্যতা সকলকে ছুঁয়ে গেছে।
মাহেরীন মৃত্যুর আগে পরিবারকে নানা বিষয়ে বলে গেছেন। ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ না করতে, প্রয়োজনে গয়না বিক্রি করতে বলেছেন। এমনকি কবরের জায়গাটাও নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন—বাবা-মায়ের কবরের পাশে। স্কুলের সহকর্মীরা জানালেন, মাহেরীন খুব নিবেদিতপ্রাণ, স্নেহশীল শিক্ষক ছিলেন। সহকর্মী নুসরাত জাহান বলেন, “যখন মাহেরীন মিসকে ধরতে গিয়েছিলাম, তখনো মনে হচ্ছিল, যেন কিছু হয়নি। কিন্তু সেটা ছিল আমাদের শেষ স্পর্শ।”
সরকার ইতিমধ্যে মাহেরীন ও তাঁর সহকর্মী মাসুকা বেগমকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাহেরীনের শেষ মুহূর্তগুলো স্মরণ করে মনসুর বলেন, তিনি হাত ধরতে চেয়েছিলেন স্ত্রীর, কিন্তু আগুনে পোড়া সেই হাত ধরার উপায় ছিল না। মাহেরীন নিজের হাতে তাঁর স্বামীর হাত তুলে বুকের ওপর রেখে বলেছিলেন, “আমি চলে যাচ্ছি, জীবনে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।”
মাহেরীনের জীবন এবং মৃত্যুর গল্প কেবল একজন শিক্ষকের নয়, বরং এক আদর্শ নারীর—যিনি মমতা, সাহস ও আত্মত্যাগ দিয়ে অগণিত মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।