মাদকাসক্ত ৮৩ লাখ, মাদকচক্রের জালে দেশ!

- আপডেট সময় ১২:২৮:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
- / ২৫১ বার পড়া হয়েছে
দেশ এখন এক ভয়াবহ সামাজিক সংকটের মুখে। মাদকাসক্তি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছে এবং সমাজে অপরাধ বাড়াচ্ছে। কিন্তু এই সমস্যা কতটা গভীর, তা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)-এর এক নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে এখন মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮৩ লাখ! এই সংখ্যাটি অতীতের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং দেশের মাদক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মাদকাসক্ত জনসংখ্যার এই প্রাক্কলন ডিএনসি’র প্রথম এ ধরনের সমীক্ষা। এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করেছিল, যেখানে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ৩৬ লাখ। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যাটি দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পাওয়াটা সত্যিই এলার্মিং।
এই ৮৩ লাখ মাদকাসক্ত মানুষ কোন মাদকে কতটুকু আসক্ত? ডিএনসি’র সমীক্ষা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মানুষ আসক্ত গাঁজায়, প্রায় ৬১ লাখ যা মোট মাদকাসক্তের প্রায় ৫২ শতাংশ। এরপরই আছে ইয়াবা, যেখানে আসক্তের সংখ্যা ২৩ লাখ, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশ।
মদ্যপানে আসক্ত ২০ লাখ ২৪ হাজার মানুষ, যা ১৭ শতাংশ। ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে আসক্তের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি, আর হেরোইনে আসক্ত প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ।
এছাড়াও, প্রায় তিন লাখের মতো মানুষ ঘুমের ওষুধকে মাদক হিসেবে গ্রহণ করেন। ড্যান্ডির মতো আঠাকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করেন ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো মানুষ। এবং প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ শিরায় মাদক গ্রহণ করেন, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক পদ্ধতি।
সব মিলিয়ে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৭৭ লাখ ৬০ হাজার পুরুষ, ২ লাখ ৮৫ হাজার নারী। এর বাইরে ২ লাখ ৫৫ হাজার শিশু-কিশোর মাদকে আসক্ত, যা এক ভয়াবহ সামাজিক সংকটকে তুলে ধরে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার দেশে পালিত হবে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ: ‘দ্য এভিডেন্স ইজ ক্লিয়ার: ইনভেস্ট ইন প্রিভেনশন। ব্রেক দ্য সাইকেল। স্টপ অর্গানাইজড ক্রাইম।’ অর্থাৎ, ‘প্রমাণ স্পষ্ট, প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন। চক্র ভেঙে ফেলুন। সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন করুন।’ এই স্লোগানটি বাংলাদেশের বর্তমান মাদক পরিস্থিতির জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হাসান মারুফ বলেন, ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপের পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে এবং মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তিনি স্বীকার করেন যে, অধিদপ্তরের সীমিত সম্পদ ও সুবিধা দিয়েই মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
কিন্তু মাদকাসক্তির এই ভয়াবহ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ কী? এর একটি বড় কারণ হলো অরক্ষিত সীমান্ত এবং মাদকের অবাধ প্রবেশ। প্রতি বছর মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে ডিএনসি মাদকবিষয়ক প্রতিবেদন (ড্রাগ রিপোর্ট) প্রকাশ করে। সে অনুযায়ী আজ ড্রাগ রিপোর্ট-২০২৪ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি হাতে এসেছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের পথ গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) এবং গোল্ডেন ওয়েজের (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ) একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান করায় এমন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।
এছাড়াও, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দেশের ৩২টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। এসব জেলার অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাদক প্রবেশ করছে। মাদকবিষয়ক প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ৮ জেলার ৪৩টি, পূর্বাঞ্চলের ৪ জেলার ২১টি, উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার ২১টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট রয়েছে। এই ১০৪টি পয়েন্ট মাদকের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করছে।