ঢাকা ০১:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

    মাহরীন চৌধুরী: যিনি নিজের জীবন দিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন শত শিক্ষার্থীকে

    নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
    • আপডেট সময় ০১:৪৬:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
    • / ২৬৭ বার পড়া হয়েছে

    উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় জীবন উৎসর্গকারী শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ আজ পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে কাজ করেছেন তিনি, কিন্তু নিজে আগুনে দগ্ধ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

    গত সোমবার দুপুরে চলমান ক্লাস চলাকালে স্কুল ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ভবনে। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। সেই সময় শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সাহসিক প্রচেষ্টার মধ্যে তিনি নিজেই অগ্নিদগ্ধ হন এবং রাতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান।

    স্বামী মনসুর হেলালের বর্ণনায় উঠে এসেছে মাহরীনের অসামান্য মনোবল ও আত্মত্যাগ। তিনি বলেন, “আমার সহধর্মিণী মাহরীন চৌধুরীকে যতটুকু চিনি, সে নৈতিকভাবে খুব দৃঢ় মনের মানুষ ছিল। মাইলস্টোন স্কুলে সে ১৭ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছে এবং বিদ্যালয় শাখার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময় তার চিন্তা ছিল, দেশের মানুষের উপকারে আসতে পারলে জীবন সার্থক।”

    দুর্ঘটনার পর মুহূর্তগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, “বার্ন ইউনিটে যখন পৌঁছালাম, দেখলাম তার শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। সে আমাকে দেখে বলল, ‘তুমি আসছো।’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি আসছি।’ সে বলল, ‘আমি আর থাকব না, আমাকে আমার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’ তারপর সে স্তব্ধ হয়ে গেল।”

    মাহরীনের স্বামী জানান, মৃত্যুর আগে মাহরীন বলেছিলেন, তাঁর খুব ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু চিকিৎসকেরা কিছুই খেতে দেননি—শুধু কয়েক ফোঁটা পানি দেওয়া হয়েছিল। সেই মুহূর্ত এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মাহরীন চৌধুরীর দুই সন্তান—১৬ বছরের আয়ান ও ১৪ বছরের আদিল—মায়ের এই বীরত্বের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরা এখনও শোকে স্তব্ধ। নীলফামারীর জলঢাকার চৌধুরীপাড়ার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা একে একে এসে তাঁদের সমবেদনা জানাচ্ছেন।

    মাহরীনের ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী জানান, বৃহস্পতিবার তাঁর বোনের জন্য বাড়িতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মাহরীনের জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়, যেখানে কবরের পাশে দেখা গেছে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

    মাইলস্টোন দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা আগেও তাঁর সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেছিলেন বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান। তিনি বলেন, “এই নারী নিজের জীবনকে পিছনে রেখে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তাঁর আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”

    মাহরীনের স্বামী মনসুর হেলালের শেষ আকুতি, “রাষ্ট্র যেন তাঁর এই আত্মত্যাগের যথাযথ সম্মান দেয়। সে যদি আমাদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি স্বার্থপর হতো, হয়তো সে বেঁচে যেত। কিন্তু সে নিজের চেয়ে বড় কিছু ভেবেছে। এমন মানুষের স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”

    নিউজটি শেয়ার করুন

    মাহরীন চৌধুরী: যিনি নিজের জীবন দিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন শত শিক্ষার্থীকে

    আপডেট সময় ০১:৪৬:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

    উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় জীবন উৎসর্গকারী শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ আজ পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে কাজ করেছেন তিনি, কিন্তু নিজে আগুনে দগ্ধ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

    গত সোমবার দুপুরে চলমান ক্লাস চলাকালে স্কুল ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ভবনে। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। সেই সময় শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সাহসিক প্রচেষ্টার মধ্যে তিনি নিজেই অগ্নিদগ্ধ হন এবং রাতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান।

    স্বামী মনসুর হেলালের বর্ণনায় উঠে এসেছে মাহরীনের অসামান্য মনোবল ও আত্মত্যাগ। তিনি বলেন, “আমার সহধর্মিণী মাহরীন চৌধুরীকে যতটুকু চিনি, সে নৈতিকভাবে খুব দৃঢ় মনের মানুষ ছিল। মাইলস্টোন স্কুলে সে ১৭ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছে এবং বিদ্যালয় শাখার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময় তার চিন্তা ছিল, দেশের মানুষের উপকারে আসতে পারলে জীবন সার্থক।”

    দুর্ঘটনার পর মুহূর্তগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, “বার্ন ইউনিটে যখন পৌঁছালাম, দেখলাম তার শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। সে আমাকে দেখে বলল, ‘তুমি আসছো।’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি আসছি।’ সে বলল, ‘আমি আর থাকব না, আমাকে আমার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’ তারপর সে স্তব্ধ হয়ে গেল।”

    মাহরীনের স্বামী জানান, মৃত্যুর আগে মাহরীন বলেছিলেন, তাঁর খুব ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু চিকিৎসকেরা কিছুই খেতে দেননি—শুধু কয়েক ফোঁটা পানি দেওয়া হয়েছিল। সেই মুহূর্ত এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মাহরীন চৌধুরীর দুই সন্তান—১৬ বছরের আয়ান ও ১৪ বছরের আদিল—মায়ের এই বীরত্বের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরা এখনও শোকে স্তব্ধ। নীলফামারীর জলঢাকার চৌধুরীপাড়ার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা একে একে এসে তাঁদের সমবেদনা জানাচ্ছেন।

    মাহরীনের ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী জানান, বৃহস্পতিবার তাঁর বোনের জন্য বাড়িতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মাহরীনের জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়, যেখানে কবরের পাশে দেখা গেছে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

    মাইলস্টোন দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা আগেও তাঁর সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেছিলেন বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান। তিনি বলেন, “এই নারী নিজের জীবনকে পিছনে রেখে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তাঁর আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”

    মাহরীনের স্বামী মনসুর হেলালের শেষ আকুতি, “রাষ্ট্র যেন তাঁর এই আত্মত্যাগের যথাযথ সম্মান দেয়। সে যদি আমাদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি স্বার্থপর হতো, হয়তো সে বেঁচে যেত। কিন্তু সে নিজের চেয়ে বড় কিছু ভেবেছে। এমন মানুষের স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”