ঢাকা ০৬:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫

    ৫ আগস্টের আগের রাত-শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের নাটকীয়তা

    নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
    • আপডেট সময় ১১:৫০:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫
    • / ২৫৮ বার পড়া হয়েছে

    গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চরম উত্তাল ও নাটকীয় দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। তার আগের রাতেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছিল যে, পরদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় নামবে, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে আর সম্ভব হবে না।

    আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের এমন বার্তার পরও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে সম্মত হননি। বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে আরও রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। ৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত তিনি আন্দোলন ঠেকাতে বাহিনীগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।

    তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তিন বাহিনীর প্রধান ও সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের সঙ্গে সেদিন দুই দফা বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। বৈঠকে আন্দোলনের ভয়াবহতা, জনগণের ক্ষোভ, বাহিনীর ক্লান্তি ও অস্ত্রস্বল্পতা সব তুলে ধরা হয়। তবু শেখ হাসিনা অনড় থাকেন।

    গণভবনের ওই রাতের বৈঠককে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক শুনানিতে “উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ংকর” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক সেনাবাহিনী দিয়ে গুলি চালানোর, এমনকি হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথাও বলেন। এতে বিমানবাহিনীর প্রধান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান এবং শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেন যে এসব পদক্ষেপ তাকে আরও ডোবাবে।

    তবে সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা সেদিন স্পষ্ট করে জানান, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় শেষ হয়ে গেছে। একই সময় প্রভাবশালী একটি দেশের কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রাত আড়াইটার দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান একটি দূতাবাসকে জানিয়ে দেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হয়েছেন।

    সেনাপ্রধান ৫ আগস্ট ভোরে ডিজিএফআই মহাপরিচালককে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সেই বিকেলেই সেনাসদরে বৈঠকে বসেন দলগুলোর প্রতিনিধিরা। বৈঠক চলাকালে সেনাপ্রধান জানতে পারেন, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

    ৫ আগস্ট সকালের বৈঠকে শেখ হাসিনাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলা হয়, পুলিশ ফোর্স ক্লান্ত, অস্ত্র স্বল্প, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। এরপরই সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন।
    তবে শেখ হাসিনা রাজি হননি। তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাতেও কাজ হয়নি। পরে সেনা কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝান। জয় মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাকে পদত্যাগে রাজি করান।

    বেলা ১১টায় আইএসপিআর বিটিভির মহাপরিচালককে জানায়, বিকেল ২টায় সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। তবে ভাষণ প্রচার হয় বিকেল ৪টায়। দেশত্যাগের সময় শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গণভবন থেকে গাড়িতে করে বাণিজ্য মেলার মাঠে যান। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে যান, এরপর সি-১৩০ বিমানযোগে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাজিয়াবাদ হিন্দন ঘাঁটিতে বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে বিমানটি অবতরণ করে। সেখানে তাকে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।

    বর্তমানে শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকে মাঝেমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে তার অডিও বার্তা প্রচারিত হয়। পালিয়ে যাওয়া আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

    ৪ ও ৫ আগস্টের এই ঘটনাপ্রবাহ, শেখ হাসিনার পদত্যাগের নাটকীয়তা এবং দেশত্যাগের প্রক্রিয়া আজও আলোচিত। এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

    নিউজটি শেয়ার করুন

    ৫ আগস্টের আগের রাত-শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের নাটকীয়তা

    আপডেট সময় ১১:৫০:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫

    গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চরম উত্তাল ও নাটকীয় দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। তার আগের রাতেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছিল যে, পরদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় নামবে, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে আর সম্ভব হবে না।

    আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের এমন বার্তার পরও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে সম্মত হননি। বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে আরও রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। ৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত তিনি আন্দোলন ঠেকাতে বাহিনীগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।

    তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তিন বাহিনীর প্রধান ও সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের সঙ্গে সেদিন দুই দফা বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। বৈঠকে আন্দোলনের ভয়াবহতা, জনগণের ক্ষোভ, বাহিনীর ক্লান্তি ও অস্ত্রস্বল্পতা সব তুলে ধরা হয়। তবু শেখ হাসিনা অনড় থাকেন।

    গণভবনের ওই রাতের বৈঠককে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক শুনানিতে “উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ংকর” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক সেনাবাহিনী দিয়ে গুলি চালানোর, এমনকি হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথাও বলেন। এতে বিমানবাহিনীর প্রধান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান এবং শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেন যে এসব পদক্ষেপ তাকে আরও ডোবাবে।

    তবে সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা সেদিন স্পষ্ট করে জানান, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় শেষ হয়ে গেছে। একই সময় প্রভাবশালী একটি দেশের কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রাত আড়াইটার দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান একটি দূতাবাসকে জানিয়ে দেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হয়েছেন।

    সেনাপ্রধান ৫ আগস্ট ভোরে ডিজিএফআই মহাপরিচালককে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সেই বিকেলেই সেনাসদরে বৈঠকে বসেন দলগুলোর প্রতিনিধিরা। বৈঠক চলাকালে সেনাপ্রধান জানতে পারেন, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

    ৫ আগস্ট সকালের বৈঠকে শেখ হাসিনাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলা হয়, পুলিশ ফোর্স ক্লান্ত, অস্ত্র স্বল্প, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। এরপরই সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন।
    তবে শেখ হাসিনা রাজি হননি। তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাতেও কাজ হয়নি। পরে সেনা কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝান। জয় মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাকে পদত্যাগে রাজি করান।

    বেলা ১১টায় আইএসপিআর বিটিভির মহাপরিচালককে জানায়, বিকেল ২টায় সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। তবে ভাষণ প্রচার হয় বিকেল ৪টায়। দেশত্যাগের সময় শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গণভবন থেকে গাড়িতে করে বাণিজ্য মেলার মাঠে যান। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে যান, এরপর সি-১৩০ বিমানযোগে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাজিয়াবাদ হিন্দন ঘাঁটিতে বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে বিমানটি অবতরণ করে। সেখানে তাকে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।

    বর্তমানে শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকে মাঝেমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে তার অডিও বার্তা প্রচারিত হয়। পালিয়ে যাওয়া আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

    ৪ ও ৫ আগস্টের এই ঘটনাপ্রবাহ, শেখ হাসিনার পদত্যাগের নাটকীয়তা এবং দেশত্যাগের প্রক্রিয়া আজও আলোচিত। এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।