জুলাই গণ–অভ্যুত্থান
দুপুরে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিয়ে রাতে বিক্ষোভ – জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ১ বছর

- আপডেট সময় ১২:২৫:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
- / ২৫৭ বার পড়া হয়েছে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই রাজধানী ঢাকায় ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় এক ঐতিহাসিক ঘটনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি শাহবাগ, মৎস্য ভবন ও শিক্ষা ভবনের সামনে দিয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছায়। পুলিশের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে অবস্থান নেন, ফলে পুরো এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এ সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করতে যায়। বেলা তিনটার দিকে তাঁরা ফিরে এসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদের অধিবেশন ডেকে আইন পাসের মাধ্যমে কোটা সংস্কার কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, স্মারকলিপিতে তাঁরা সুপারিশ করেছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত আইন পাস করা হোক। অপর সমন্বয়ক ও বর্তমান নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম বলেন, তাঁদের দাবি অনুযায়ী শুধুমাত্র সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রেখে আইন প্রণয়ন করা উচিত।
এই দিন শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয়, সারা দেশের জেলা শহরগুলোতেও একই দাবিতে শিক্ষার্থীরা ‘গণপদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে যান এবং রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে স্মারকলিপি দেন।
প্রথমে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও বিকেল গড়াতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই দিন বিকেলে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য আন্দোলনে নতুন মোড় আনে। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?” এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দেয়।
রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসেন এবং spontaneous মিছিল শুরু হয়। মিছিলে স্লোগান ওঠে— “তুমি কে, আমি কে— রাজাকার রাজাকার”, “কে বলেছে রাজাকার— সরকার সরকার”, “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার”। রাতভর হাজারো শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেই রাতে এমন অনেক ছাত্রী রাস্তায় নেমেছিলেন, যাঁরা আগে কখনো রাজনীতি বা আন্দোলনে অংশ নেননি। তাঁরা থালা, বাটি, চামচ নিয়ে স্লোগান দিয়েছেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর তৎকালীন লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য এবং বর্তমানে নাগরিক পার্টির নেতা আকরাম হুসাইন বলেন, “সেদিন ছাত্রীদের এমনভাবে রাস্তায় নামতে দেখে মনে হয়েছিল, শেখ হাসিনার ক্ষমতার সময় শেষ হয়ে আসছে।”
বিক্ষোভ শেষে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের এলাকা থেকে সরে গেলেও রাত তিনটার দিকে ক্যাম্পাসে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা, যা আন্দোলনকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়।
এই দিনটি বাংলাদেশ ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। একটি শান্তিপূর্ণ দাবির মুখে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য এবং তার জবাবে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত রাস্তায় নেমে আসা— এ যেন এক প্রজন্মের ক্ষোভের বিস্ফোরণ।