ঢাকা ১১:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

    শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন দিলেন : মাহেরীন চৌধুরী

    নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
    • আপডেট সময় ০১:০৯:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
    • / ২৫৮ বার পড়া হয়েছে

    রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যখন পুরো ভবন দাউদাউ করে জ্বলছিল, তখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে নয়, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ছুটছিলেন শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। তিনি চাইলে বের হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে শিক্ষার্থীদের আগে বের করার চেষ্টা করলেন। এক মায়ের মতো শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিলেন তিনি। আর ঘরে রইল তাঁর মা-হারা দুই সন্তান।

    সোমবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনে বিমানটি আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে, যেখানে বেশিরভাগই ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অগ্নিদগ্ধ হয় শিশু শিক্ষার্থীরা। সেই আগুনে প্রাণ হারান তাঁদের প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী, যিনি স্কুলের শাখা সমন্বয়ক ছিলেন।

    মাহেরীনের স্বামী মনসুর হেলাল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি মাহেরীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’”

    ভাই মুনাফ চৌধুরী জানান, ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন—মাহেরীন চাইলে বের হতে পারতেন। কিন্তু তিনি বের হননি। তাঁর সমস্ত চেষ্টা ছিল বাচ্চাদের আগেই বাইরে বের করে দেওয়ার। এ চেষ্টাই তাঁর জীবনের জন্য শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়।

    দুর্ঘটনার পরপরই পরিবারের একজনকে ফোন করে জানানো হয়, মাহেরীনের অবস্থা গুরুতর এবং তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পৌঁছালে দেখা যায়, মাহেরীন তখনো বেঁচে আছেন, কথা বলতেও পারছেন। কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার তীব্রতায় তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে যায়। আইসিইউতে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর শরীরের শতভাগই দগ্ধ হয়েছে। রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন।

    মঙ্গলবার বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে মাহেরীনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে। সাড়ে ৩টায় বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শতশত মানুষ তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে এবং বিদায় জানাতে ছুটে আসেন। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে, বাবার কবরের পাশে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।

    জানাজার আগে উপস্থিত সবার উদ্দেশে মাহেরীনের স্বামী বলেন, “আমার স্ত্রী আপনাদের অনেক ভালোবাসতেন। আজ আপনাদের এই উপস্থিতি প্রমাণ করছে, আপনারাও তাঁকে ভালোবেসেছেন। তিনি বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি ছিলেন। গ্রামে শিক্ষাবিস্তারে কাজ করতেন। আমরা তাঁর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।”

    উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন বলেন, “মাহেরীন চৌধুরী একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। কখনো কারও প্রতি অন্যায় করেননি বা অন্যায় কাজে জড়াননি। গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।”

    মাহেরীন চৌধুরী ছিলেন বগুলাগাড়ি চৌধুরী পরিবারের সন্তান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। তাঁর আত্মত্যাগ আজ শুধু একটি শিক্ষিকার মৃত্যু নয়, বরং এক মমতাময়ী মানবিক রোল মডেলের চিরবিদায়। নিজের সন্তানদের মতো করে শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে তিনি যেভাবে নিজের জীবন দিয়ে গেলেন, তা সবার হৃদয়ে চিরদিন গেঁথে থাকবে।

    নিউজটি শেয়ার করুন

    শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন দিলেন : মাহেরীন চৌধুরী

    আপডেট সময় ০১:০৯:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

    রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যখন পুরো ভবন দাউদাউ করে জ্বলছিল, তখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে নয়, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ছুটছিলেন শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। তিনি চাইলে বের হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে শিক্ষার্থীদের আগে বের করার চেষ্টা করলেন। এক মায়ের মতো শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিলেন তিনি। আর ঘরে রইল তাঁর মা-হারা দুই সন্তান।

    সোমবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনে বিমানটি আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে, যেখানে বেশিরভাগই ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অগ্নিদগ্ধ হয় শিশু শিক্ষার্থীরা। সেই আগুনে প্রাণ হারান তাঁদের প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী, যিনি স্কুলের শাখা সমন্বয়ক ছিলেন।

    মাহেরীনের স্বামী মনসুর হেলাল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি মাহেরীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’”

    ভাই মুনাফ চৌধুরী জানান, ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন—মাহেরীন চাইলে বের হতে পারতেন। কিন্তু তিনি বের হননি। তাঁর সমস্ত চেষ্টা ছিল বাচ্চাদের আগেই বাইরে বের করে দেওয়ার। এ চেষ্টাই তাঁর জীবনের জন্য শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়।

    দুর্ঘটনার পরপরই পরিবারের একজনকে ফোন করে জানানো হয়, মাহেরীনের অবস্থা গুরুতর এবং তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পৌঁছালে দেখা যায়, মাহেরীন তখনো বেঁচে আছেন, কথা বলতেও পারছেন। কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার তীব্রতায় তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে যায়। আইসিইউতে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর শরীরের শতভাগই দগ্ধ হয়েছে। রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন।

    মঙ্গলবার বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে মাহেরীনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে। সাড়ে ৩টায় বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শতশত মানুষ তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে এবং বিদায় জানাতে ছুটে আসেন। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে, বাবার কবরের পাশে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।

    জানাজার আগে উপস্থিত সবার উদ্দেশে মাহেরীনের স্বামী বলেন, “আমার স্ত্রী আপনাদের অনেক ভালোবাসতেন। আজ আপনাদের এই উপস্থিতি প্রমাণ করছে, আপনারাও তাঁকে ভালোবেসেছেন। তিনি বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি ছিলেন। গ্রামে শিক্ষাবিস্তারে কাজ করতেন। আমরা তাঁর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।”

    উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন বলেন, “মাহেরীন চৌধুরী একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। কখনো কারও প্রতি অন্যায় করেননি বা অন্যায় কাজে জড়াননি। গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।”

    মাহেরীন চৌধুরী ছিলেন বগুলাগাড়ি চৌধুরী পরিবারের সন্তান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। তাঁর আত্মত্যাগ আজ শুধু একটি শিক্ষিকার মৃত্যু নয়, বরং এক মমতাময়ী মানবিক রোল মডেলের চিরবিদায়। নিজের সন্তানদের মতো করে শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে তিনি যেভাবে নিজের জীবন দিয়ে গেলেন, তা সবার হৃদয়ে চিরদিন গেঁথে থাকবে।