ঢাকা ১১:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫

    তৌকিরের শেষ মিশন: নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হলো যুদ্ধবিমান, নিয়তির শিকার হলেন শিক্ষার্থীরা

    নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
    • আপডেট সময় ০৩:৫৫:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
    • / ২৬০ বার পড়া হয়েছে

    ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক দিন ছিল সেদিন। তার মিশন ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের একটি সলো ফ্লাইট—এটাই ছিল তার প্রথম একক উড্ডয়ন। সকালবেলা একটি চেক রাইডের মাধ্যমে তার ফ্লাইট উপযোগিতা যাচাই করেন তার কমান্ডিং অফিসার। পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকেই পাঠানো হয় এই মিশনে।

    সাধারণত এমন গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইটে কমান্ডিং অফিসার সরাসরি পর্যবেক্ষণে থাকেন। সেদিনও তিনি মোবাইল হাটে বসে রেডিও যোগাযোগের মাধ্যমে তৌকিরের প্রতিটি মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিমানটির উড্ডয়ন ছিল নিকুঞ্জের দিকে, আর ল্যান্ড করার কথা ছিল বিপরীত দিক থেকে ঘুরে এসে। প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ড স্বাভাবিকভাবেই শেষ করেন তৌকির। তবে তৃতীয় রাউন্ডে কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে কমান্ডিং অফিসারের।

    বাইনোকুলারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—তৌকিরের বিমান উচ্চতা হারাচ্ছে, যা তখনকার ফ্লাইট রুটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তৎক্ষণাৎ রেডিওতে কমান্ডিং অফিসার তাকে সতর্ক করেন, “চেক ইয়োর হাইট।” পাইলট তৌকির ‘কপিড’ বা ‘রজার’ জানিয়ে উত্তর দেন। মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো ভুলক্রমে উচ্চতা হারাচ্ছেন। তবে কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট হয়, বিমানটি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে, এবং তা বিপজ্জনক গতিতে।

    এই পর্যায়ে কমান্ডিং অফিসার দুইবার ‘ইজেক্ট, ইজেক্ট’ নির্দেশ দেন। প্রতিটি যুদ্ধবিমানে থাকা ইজেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে পাইলট চাইলেই এক সেকেন্ডের মধ্যে বিমান থেকে বের হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তৌকির কোনো জবাব দেননি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি তখন বিমানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, যা একটি সাধারণ পরিস্থিতি। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে পাইলট প্রথমে কন্ট্রোল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে, পরে যদি ব্যর্থ হয়, তবে ইজেক্ট করে।

    একই ধরনের অভিজ্ঞতা বহু পাইলটের জীবনে ঘটে থাকে, যেখানে মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তৌকির বিমানটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। বিধ্বস্ত হয় বিমানটি—ঢাকার উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর। প্রাণ হারান অসংখ্য কোমলমতি শিক্ষার্থী, আহত হন অনেকে।

    বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিমানটি পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তবে বিমানবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফটি-৭ যুদ্ধবিমানটি ২০১৩ সালে চীনে তৈরি, যা এখনো ব্যবহারের উপযোগী। তাছাড়া, সলো ফ্লাইটের পূর্বে পাইলটের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা যাচাই করা হয়, এবং যান্ত্রিকভাবে বিমানের উপযোগিতাও নিশ্চিত করা হয়।

    সবশেষে বলা যায়, দুর্ঘটনার সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির তার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছিলেন বিমান নিয়ন্ত্রণে আনার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে তা সম্ভব হয়নি। আর এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ, বিশেষ করে শিশুদের, যারা তখন স্কুল প্রাঙ্গণে স্বপ্ন বুনছিল।

    এ ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি হয়ে রইল জাতির হৃদয়ে চিরস্থায়ী বেদনার এক অধ্যায়।

    নিউজটি শেয়ার করুন

    তৌকিরের শেষ মিশন: নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হলো যুদ্ধবিমান, নিয়তির শিকার হলেন শিক্ষার্থীরা

    আপডেট সময় ০৩:৫৫:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

    ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক দিন ছিল সেদিন। তার মিশন ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের একটি সলো ফ্লাইট—এটাই ছিল তার প্রথম একক উড্ডয়ন। সকালবেলা একটি চেক রাইডের মাধ্যমে তার ফ্লাইট উপযোগিতা যাচাই করেন তার কমান্ডিং অফিসার। পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকেই পাঠানো হয় এই মিশনে।

    সাধারণত এমন গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইটে কমান্ডিং অফিসার সরাসরি পর্যবেক্ষণে থাকেন। সেদিনও তিনি মোবাইল হাটে বসে রেডিও যোগাযোগের মাধ্যমে তৌকিরের প্রতিটি মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিমানটির উড্ডয়ন ছিল নিকুঞ্জের দিকে, আর ল্যান্ড করার কথা ছিল বিপরীত দিক থেকে ঘুরে এসে। প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ড স্বাভাবিকভাবেই শেষ করেন তৌকির। তবে তৃতীয় রাউন্ডে কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে কমান্ডিং অফিসারের।

    বাইনোকুলারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—তৌকিরের বিমান উচ্চতা হারাচ্ছে, যা তখনকার ফ্লাইট রুটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তৎক্ষণাৎ রেডিওতে কমান্ডিং অফিসার তাকে সতর্ক করেন, “চেক ইয়োর হাইট।” পাইলট তৌকির ‘কপিড’ বা ‘রজার’ জানিয়ে উত্তর দেন। মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো ভুলক্রমে উচ্চতা হারাচ্ছেন। তবে কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট হয়, বিমানটি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে, এবং তা বিপজ্জনক গতিতে।

    এই পর্যায়ে কমান্ডিং অফিসার দুইবার ‘ইজেক্ট, ইজেক্ট’ নির্দেশ দেন। প্রতিটি যুদ্ধবিমানে থাকা ইজেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে পাইলট চাইলেই এক সেকেন্ডের মধ্যে বিমান থেকে বের হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তৌকির কোনো জবাব দেননি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি তখন বিমানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, যা একটি সাধারণ পরিস্থিতি। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে পাইলট প্রথমে কন্ট্রোল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে, পরে যদি ব্যর্থ হয়, তবে ইজেক্ট করে।

    একই ধরনের অভিজ্ঞতা বহু পাইলটের জীবনে ঘটে থাকে, যেখানে মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তৌকির বিমানটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। বিধ্বস্ত হয় বিমানটি—ঢাকার উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর। প্রাণ হারান অসংখ্য কোমলমতি শিক্ষার্থী, আহত হন অনেকে।

    বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিমানটি পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তবে বিমানবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফটি-৭ যুদ্ধবিমানটি ২০১৩ সালে চীনে তৈরি, যা এখনো ব্যবহারের উপযোগী। তাছাড়া, সলো ফ্লাইটের পূর্বে পাইলটের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা যাচাই করা হয়, এবং যান্ত্রিকভাবে বিমানের উপযোগিতাও নিশ্চিত করা হয়।

    সবশেষে বলা যায়, দুর্ঘটনার সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির তার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছিলেন বিমান নিয়ন্ত্রণে আনার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে তা সম্ভব হয়নি। আর এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ, বিশেষ করে শিশুদের, যারা তখন স্কুল প্রাঙ্গণে স্বপ্ন বুনছিল।

    এ ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি হয়ে রইল জাতির হৃদয়ে চিরস্থায়ী বেদনার এক অধ্যায়।