০১:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে টানাপড়েন !

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
  • আপডেট সময় ০৭:০৫:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
  • / ৫ বার পড়া হয়েছে

পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পাকিস্তান শুধু ভারতের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যই বন্ধ করেনি, তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে বাণিজ্যের জন্যও তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না।

এছাড়া ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে প্রায় দুই ঘণ্টার জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

এই পদক্ষেপ ভারতের বুধবারের সিদ্ধান্তের জবাবে এসেছে। ভারত ঘোষণা করেছিল যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ না করা পর্যন্ত ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত থাকবে।

ভারতের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান। তারা বলেছে, সিন্ধু নদী ও তার শাখার পানির প্রবাহে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তা যুদ্ধের সমান গণ্য হবে। পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেখারি ভারতের এই পদক্ষেপকে “জল যুদ্ধ” এবং “অবৈধ” বলে অভিহিত করেছেন।

সিন্ধু জলচুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সিন্ধু জলচুক্তি ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ছয়টি নদী—রাভি, বিয়াস, সতলুজ, সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব—এর পানি ভাগাভাগির নিয়ম নির্ধারণ করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভারত পায় রাভি, বিয়াস ও সতলুজ নদীর পানি, আর পাকিস্তান পায় সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পানি। পাকিস্তানের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য এই পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ চাষের জমি এই নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল, যা দেশের অর্থনীতির ২৫ শতাংশ অবদান রাখে।

কী কারণে এই উত্তেজনা?

এই পদক্ষেপের পেছনে কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের একটি ভয়াবহ হামলা রয়েছে। এই হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে বলেছে, এটি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ করেছে, যা লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটি (সিসিএস) বৈঠক করে কয়েকটি কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়।

ভারতের অন্যান্য পদক্ষেপ

আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ও মানুষের চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্ত তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমতি নিয়ে যারা সীমান্ত পার হয়েছেন, তাদের ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে ফিরতে হবে।

সার্ক ভিসা বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। পূর্বে দেওয়া ভিসাগুলোও অকার্যকর। ভারতে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে।

কূটনৈতিক সম্পর্কে ছাঁটাই: দিল্লিতে পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। ভারতও ইসলামাবাদে তাদের সামরিক উপদেষ্টাদের ফিরিয়ে আনছে। দুই দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হবে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া:

পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেছে এবং ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা বাতিল করেছে। এছাড়া ভারতের সিদ্ধান্তকে তারা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেছে। সাবেক মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, এটি পাঞ্জাব ও সিন্ধের গরিব কৃষকদের ক্ষতি করবে। সাবেক মন্ত্রী হুসাইন জানিয়েছেন, পাকিস্তান এই বিষয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে পারে।

সম্ভাব্য প্রভাব:

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্য ও পানি নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের কৃষি এই নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে ভারতের পক্ষে পানি পুরোপুরি বন্ধ করা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়, কারণ এর জন্য বাঁধ নির্মাণে অনেক সময় লাগবে। এটি মূলত পাকিস্তানের ওপর মানসিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল।

এই ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই উত্তেজনা কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা এখন দেখার বিষয়।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে টানাপড়েন !

আপডেট সময় ০৭:০৫:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পাকিস্তান শুধু ভারতের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যই বন্ধ করেনি, তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে বাণিজ্যের জন্যও তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না।

এছাড়া ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে প্রায় দুই ঘণ্টার জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

এই পদক্ষেপ ভারতের বুধবারের সিদ্ধান্তের জবাবে এসেছে। ভারত ঘোষণা করেছিল যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ না করা পর্যন্ত ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত থাকবে।

ভারতের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান। তারা বলেছে, সিন্ধু নদী ও তার শাখার পানির প্রবাহে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তা যুদ্ধের সমান গণ্য হবে। পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেখারি ভারতের এই পদক্ষেপকে “জল যুদ্ধ” এবং “অবৈধ” বলে অভিহিত করেছেন।

সিন্ধু জলচুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সিন্ধু জলচুক্তি ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ছয়টি নদী—রাভি, বিয়াস, সতলুজ, সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব—এর পানি ভাগাভাগির নিয়ম নির্ধারণ করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভারত পায় রাভি, বিয়াস ও সতলুজ নদীর পানি, আর পাকিস্তান পায় সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পানি। পাকিস্তানের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য এই পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ চাষের জমি এই নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল, যা দেশের অর্থনীতির ২৫ শতাংশ অবদান রাখে।

কী কারণে এই উত্তেজনা?

এই পদক্ষেপের পেছনে কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের একটি ভয়াবহ হামলা রয়েছে। এই হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে বলেছে, এটি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ করেছে, যা লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটি (সিসিএস) বৈঠক করে কয়েকটি কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়।

ভারতের অন্যান্য পদক্ষেপ

আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ও মানুষের চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্ত তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমতি নিয়ে যারা সীমান্ত পার হয়েছেন, তাদের ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে ফিরতে হবে।

সার্ক ভিসা বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। পূর্বে দেওয়া ভিসাগুলোও অকার্যকর। ভারতে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে।

কূটনৈতিক সম্পর্কে ছাঁটাই: দিল্লিতে পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। ভারতও ইসলামাবাদে তাদের সামরিক উপদেষ্টাদের ফিরিয়ে আনছে। দুই দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হবে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া:

পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেছে এবং ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা বাতিল করেছে। এছাড়া ভারতের সিদ্ধান্তকে তারা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেছে। সাবেক মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, এটি পাঞ্জাব ও সিন্ধের গরিব কৃষকদের ক্ষতি করবে। সাবেক মন্ত্রী হুসাইন জানিয়েছেন, পাকিস্তান এই বিষয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে পারে।

সম্ভাব্য প্রভাব:

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্য ও পানি নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের কৃষি এই নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে ভারতের পক্ষে পানি পুরোপুরি বন্ধ করা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়, কারণ এর জন্য বাঁধ নির্মাণে অনেক সময় লাগবে। এটি মূলত পাকিস্তানের ওপর মানসিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল।

এই ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই উত্তেজনা কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা এখন দেখার বিষয়।