ঐতিহ্যের প্রত্যাবর্তন: হুইসেলের ধ্বনিতে ফিরছে বরিশালের স্মৃতিময় স্টিমার যাত্রা

- আপডেট সময় ১২:৩০:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
- / ২৫৫ বার পড়া হয়েছে
বরিশাল, এক নদীমাতৃক জনপদ, যেখানে প্রতিটি ঘাট বহন করে জলযাত্রার নীরব ইতিহাস। একসময় এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা স্টিমার ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। সেই ঐতিহ্য, দেড়শ বছরের স্মৃতি, ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থমকে গিয়েছিল। কিন্তু সেই নীরবতা ভাঙতে চলেছে।
গত শনিবার বিকেলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বরিশালের মানুষের জন্য নিয়ে এলেন এক সুখবর—আবার চালু হচ্ছে সেই ঐতিহ্যবাহী স্টিমার সেবা। এই ঘোষণার পর থেকেই যেন নগরীর বাতাসে পুরনো সেই হুইসেলের প্রতিধ্বনি, স্টিমারের ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ এবং যাত্রার সেই চেনা উত্তেজনা ফিরে এসেছে। বান্দরোডের কীর্তনখোলা পাড়ের পরিত্যক্ত স্টিমারঘাটে এখনো প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে দাঁড়াতেন—স্মৃতির টানে, পুরোনো দিনের প্রত্যাশায়। এবার সেই অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।
স্টিমার এবং লঞ্চ—উভয়ই নৌযান, তবে তারা যেন দুটি ভিন্ন সময়ের প্রতিচ্ছবি। স্টিমার ছিল এক ভাসমান প্রাসাদ, শুরুতে কয়লার বাষ্পে চালিত, পরবর্তীতে ডিজেলে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিশাল প্যাডেল হুইল, কাঠের উষ্ণ অভ্যন্তর, দোতলা কাঠামো এবং প্রশস্ত বারান্দা। এই সবকিছু মিলিয়ে স্টিমারের যাত্রা ছিল এক স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে, লঞ্চ হলো আধুনিক যুগের চাহিদা মেটানো দ্রুতগামী নৌযান, যেখানে আধুনিক ইঞ্জিন, বহুতল কাঠামো এবং প্লাস্টিক বা ধাতব আসবাবের আধিক্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা যায়, এই স্টিমার সেবার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, ১৮৮৪ সালে। কয়লাচালিত প্যাডেল স্টিমার প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ও পরে ঢাকা থেকে সরাসরি খুলনার নৌপথে চলাচল করত। চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, মোরেলগঞ্জ, হুলারহাট, সন্ন্যাসী ও কাউখালী ঘাটে যাত্রাবিরতি শেষে এটি খুলনায় পৌঁছাত।
ঔপনিবেশিক যুগে খুলনার সাথে ভারতের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে নৌপথে যাত্রী পরিবহনের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তখন ফ্লোটিলা কোম্পানির বহরে ১৪টি স্টিমার ছিল। পরবর্তীতে পিএস গাজী, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা, পিএস টার্ন ও পিএস সেলারের মতো ঐতিহ্যবাহী স্টিমারগুলো এই নৌবহরে যুক্ত হয়—যা ছিল নদীমাতৃক সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ।
বরিশালবাসীর কাছে স্টিমার কেবল একটি নৌযান ছিল না, ছিল নির্ভরতার প্রতীক। ঝড়-বৃষ্টি, জোয়ার-ভাটা উপেক্ষা করে এই স্টিমার যাত্রীদের নিরাপদে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিত। এটি ছিল নিরাপদ ও আরামদায়ক। শতবর্ষ ধরে সেবা দেওয়া এই স্টিমারগুলো পর্যটকদের কাছেও ছিল এক বিশেষ আকর্ষণ।
তবে সময়ের সাথে সাথে বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, সড়ক যোগাযোগের উন্নতি, লঞ্চ মালিকদের প্রভাব এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মতো কারণে স্টিমার সেবা ক্রমশ চাপের মুখে পড়ে। যাত্রী ও নাব্যতা সংকটের কারণে ২০১৯ সাল থেকে স্টিমার চলাচল সীমিত হয়ে আসে।
খুলনার পরিবর্তে যাত্রা মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ এমভি মধুমতি ও এমভি বাঙালি সপ্তাহে চার দিন ঢাকা-মোরেলগঞ্জ নৌপথে চলাচল করত। সেই ঐতিহ্যবাহী যাত্রার শেষ ঘণ্টা বেজেছিল ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর।