খামেনি কোথায়: ইরানের সর্বোচ্চ নেতার রহস্যময় অনুপস্থিতি!

- আপডেট সময় ০৩:৫০:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
- / ২৫২ বার পড়া হয়েছে
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান সব সময়ই এক গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় রাষ্ট্র। আর সেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, যিনি দেশটির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি – তিনি এখন কোথায়?
গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জনসমক্ষে তার অনুপস্থিতি দেশটির ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে জন্ম দিয়েছে গভীর উদ্বেগ ও নানা প্রশ্নের।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ইরানের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: খামেনি কোথায় এবং তার কী হয়েছে?
দেশজুড়ে মানুষ যখন উৎকণ্ঠায়, তখন ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিলেন। গত মঙ্গলবার উপস্থাপক আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দপ্তরের এক কর্মকর্তাকে বলেন, “মানুষ সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়ে খুব চিন্তিত।”
তিনি জানতে চান, “তাঁর কী অবস্থা, বলতে পারেন?” উপস্থাপক ওই কর্মকর্তাকে জানান যে, দর্শকদের কাছ থেকে এই একই প্রশ্নে তাদের বার্তাকক্ষ ভরে গেছে।
কিন্তু খামেনির আর্কাইভ দপ্তরের কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলি সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। উল্টো ফাজায়েলি বলেন, “আমরাও অনেক জায়গা থেকে এমন উদ্বেগের খবর পাচ্ছি। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা হামলার পর আয়াতুল্লাহর নিরাপত্তা নিয়ে বহুজন উদ্বিগ্ন।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের সবাইকে তাঁর জন্য দোয়া করতে হবে।” এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা তাঁদের কাজ ভালোভাবেই করছেন। আল্লাহ চাইলে, আমাদের জনগণ তাঁদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদ্যাপন করতে পারবেন।” এই ধরনের প্রোটোকলমাফিক উত্তর আসলে উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই জনসমক্ষে অনুপস্থিত খামেনি। কোনো ভাষণ বা বার্তাও দেননি। অথচ এই সময়ে ইরান ছিল গভীর সংকটে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, জবাবে ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে (মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি) ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরায়েল এক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়, যা কার্যকর হয় মঙ্গলবার সকাল থেকে।
এই পুরো সময়ে খামেনি ছিলেন অনুপস্থিত। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি এক সুরক্ষিত বাংকারে আছেন এবং হত্যাচেষ্টার আশঙ্কায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন। কিন্তু একজন দেশের সর্বোচ্চ নেতা, যিনি প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন, তার এমন দীর্ঘ অনুপস্থিতি কেবল জনসাধারণ নয়, রাজনৈতিক মহলেও ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে।
‘খানমান’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ বলেন, “খামেনির কয়েক দিনের এ অনুপস্থিতি আমাদের, যাঁরা তাঁকে ভালোবাসি, গভীর উদ্বেগে ফেলেছে।”
দুই সপ্তাহ আগেও যে আশঙ্কা অকল্পনীয় ছিল, তা এখন স্বীকার করে তিনি বলেন, “যদি তিনি (খামেনি) মারা যান, তাঁর জানাজার মিছিল হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গৌরবময়।” তার এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, খামেনির স্বাস্থ্য নিয়ে গুরুতর কিছু ঘটেছে এমন আশঙ্কা ইরানিদের মনে দানা বাঁধছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন খামেনি। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তে তাঁর অনুমোদন অত্যাবশ্যক। তাহলে তার অনুপস্থিতিতে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো কে নিচ্ছেন?
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে এবং কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় দ্রুত সম্পাদিত হয়। তবে ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তারা গত কয়েক দিনে তাঁরা খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কি না বা কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে কি না, সে বিষয়ে খোলাখুলি কিছু বলেননি।
এই নীরবতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার—সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে খামেনির ভূমিকা কতটুকু? তাঁর কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি? তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ, আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা সাফাভি, যিনি আয়াতুল্লাহ খামেনির শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা ও রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের জেনারেল ইয়াহিয়া সাফাভির ছেলে, তিনি জানান, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে। তাই তাঁর নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
সাফাভি আরও বলেন, “দেশকে এ সংকট থেকে উত্তরণে এখন বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মতো নেতাদের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।” তবে সাফাভির ধারণা, খামেনি এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দূর থেকে অনুমোদন দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে, খামেনির অনুপস্থিতিতে ইরানের ক্ষমতার কেন্দ্রে একটি নতুন খেলা শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।