সীমান্ত বিভাজন
মায়ের কোল থেকে কেড়ে নেওয়া হলো ৯ মাসের দুধের শিশুকে

- আপডেট সময় ০৬:৩২:২৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
- / ৫ বার পড়া হয়েছে
সীমান্ত – একটি রেখা, যা দুটি দেশকে শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয়, হৃদয়কেও আলাদা করে দেয়। ভালোবাসার গল্প যখন এই সীমান্তের বেড়াজালে আটকা পড়ে, তখন তা জন্ম দেয় এক গভীর বেদনার। তেমনই এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হলো ভারত-পাকিস্তানের ওয়াঘা সীমান্ত।
মঙ্গলবার, একটি নয় মাসের দুধের শিশুকে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো শুধু একটি পাসপোর্টের কারণে। পাকিস্তানের করাচি থেকে আসা সাইরা নামের এক নারীকে ফেরত পাঠানো হলো তার নিজের দেশে, কিন্তু তার নিষ্পাপ সন্তান আজলানকে রেখে যেতে বাধ্য করা হলো ভারতের মাটিতে।
সাইরা তার স্বামী ফারহান এবং তাদের ছোট্ট সন্তান আজলানকে নিয়ে দিল্লিতে বসবাস করছিলেন। ফারহান দিল্লির পুরনো শহরের একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তিন বছর আগে ফেসবুকে তাদের পরিচয় হয়। সেই ভার্চুয়াল জগত থেকে জন্ম নেয় প্রেম, যা পরিণতি পায় বিবাহে। করাচির আর্টস গ্র্যাজুয়েট সাইরা দিল্লিতে এসে ফারহানের সাথে একটি ছোট্ট সুখের সংসার গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু, গত ২২শে এপ্রিল কাশ্মীরের পাহলগামে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ হামলার পর ভারত সরকার এক আকস্মিক নির্দেশ জারি করে। সেই নির্দেশে বলা হয়, ভারতে বসবাসকারী সকল পাকিস্তানি নাগরিককে আগামী ২৬শে এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই অপ্রত্যাশিত নির্দেশের জেরেই সাইরা ও ফারহান মঙ্গলবার রাতে দীর্ঘ পথ সফর করে ওয়াঘা সীমান্তে পৌঁছান, তাদের কোলে ছিল তাদের নয় মাসের শিশু সন্তান আজলান।
সীমান্তে পৌঁছানোর পর এক হৃদয়বিদারক তথ্য তাদের জানানো হয়। আজলানের পাসপোর্টটি ভারতীয়, তাই শিশুটিকে তার মায়ের সাথে পাকিস্তানে যেতে দেওয়া যাবে না। কোলের সন্তানকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করার এই নিষ্ঠুর নির্দেশে মুহূর্তে ভেঙে পড়েন সাইরা। মা এবং সন্তানের বিচ্ছেদের সেই করুণ দৃশ্য সেখানে উপস্থিত সকলের হৃদয় নাড়া দেয়।
ফারহান, স্ত্রীর হাত ধরে আকুতি জানিয়েছিলেন, ‘শুধু একটু সময় দাও’। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা ছিলেন কঠোর, তাদের উপর ছিল দ্রুত স্থান ত্যাগের নির্দেশ। অসহায় সাইরার দুই চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল। শেষবারের মতো নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাকিস্তানের দিকে পা বাড়াতে বাধ্য হন তিনি।
বিদায় নেওয়ার সেই মুহূর্তে সাইরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফেরার পর তার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরা মানবিক দিক বিবেচনা করে শেষবারের মতো স্বামী-স্ত্রীর ক্ষণিকের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সাক্ষাৎ ছিল শুধু বিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে আরও গভীর করার মতোই।
সাইরার এই মর্মান্তিক ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ২২শে এপ্রিলের পর থেকে প্রায় ৭৫০ জনেরও বেশি পাকিস্তানি নাগরিক ভারত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। একইসঙ্গে, হাজারেরও বেশি ভারতীয়ও পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন প্রবাসী স্ত্রী, অসুস্থ রোগী, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে আসা মানুষ, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা অতিথিরাও।
৪৮ বছর বয়সী হালিমা বেগম, যিনি ২৫ বছর আগে করাচি থেকে উড়িষ্যায় এসেছিলেন তার স্বামীর সাথে সংসার করতে, তাকেও ফেরত পাঠানো হয়েছে। পেছনে ফেলে যেতে হয়েছে তার ভারতীয় সন্তানদের। কান্নায় ভেঙে পড়া হালিমা বেগম বলেছিলেন, ‘এই দেশই আমার ঘর ছিল, এখন আমি কোথায় যাব? করাচিতে আমার তো কেউ নেই।’
মানবাধিকার কর্মীরা এই ধরনের আচরণকে সরাসরি মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছেন। প্রখ্যাত লেখিকা সুচিত্রা বিজয়ন এই ঘটনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাসে এই ধরনের ভালোবাসা বহুবার এমন করুণ পরিণতির শিকার হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই হয়তো ভাবে, তারা সাময়িকভাবে ফিরছেন, কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, সেই সাময়িক বিচ্ছেদ আর কখনও শেষ হয় না, সেটি চিরস্থায়ী হয়ে যায়।’
সীমান্তে দাঁড়িয়ে যখন ফারহান তার নয় মাসের শিশু আজলানকে বোতলে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন তার মানসপটে বারবার ভেসে উঠছিল সাইরার মুখ। ফারহানের মা, যিনি পা ভাঙা অবস্থাতেও ছেলের সাথে এসেছিলেন, বেদনার্ত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘এরা সবাই ভালোবাসার শিকার।’ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি একটি গভীর সত্য উচ্চারণ করেন, ‘পাতালে গিয়ে প্রেম করো, তবুও পাকিস্তানে গিয়ে করো না।’