সর্বজনীন পেনশনে ‘কচ্ছপগতি’: শেষ সাড়ে ৯ মাসে মাত্র ১৯০০ নিবন্ধন

- আপডেট সময় ০২:০০:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
- / ২৫২ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে চালু হয়েছিল সর্বজনীন পেনশন স্কিম। সরকার আশা করেছিল, এর মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণ একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আসবে। শুরুর দিকে এই স্কিমে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও, সম্প্রতি এক ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
গত প্রায় এক বছর ধরে নিবন্ধনের গতি যেন ‘কচ্ছপগতি’তে চলছে! শেষ সাড়ে নয় মাসে মাত্র ১ হাজার ৯৬৩ জন নতুন করে নিবন্ধন করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এই ধীরগতির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রধান কারণ হলো, সরকার পতনের পর সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু আছে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার পালাবদল মানুষের মনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি, পেনশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও তেমন জোরালো প্রচারণা চালানো হয়নি, যার কারণে নিবন্ধনের গতি বেশ কমে যায়। সাধারণ মানুষ হয়তো নিশ্চিত হতে পারেননি যে, নতুন সরকার এই প্রকল্প অব্যাহত রাখবে কিনা।
তবে, এই ‘কচ্ছপগতি’ কাটিয়ে নিবন্ধনের গতি বাড়াতে সরকার এখন মাঠে নামছে। ইতোমধ্যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের সাতটি জেলা – রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে পেনশন মেলা করা হয়েছে। এই মেলাগুলোতে সরাসরি মানুষের কাছে গিয়ে পেনশন স্কিমের সুবিধাগুলো তুলে ধরা হচ্ছে এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা হচ্ছে।
এছাড়াও, পেনশন স্কিমে নিবন্ধন কার্যক্রমের জন্য কিছু বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সঙ্গে চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এনজিওগুলো তৃণমূলে কাজ করে এবং সাধারণ মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারে, যা নিবন্ধনের গতি বাড়াতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে, যাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও এই স্কিম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে।
নিবন্ধনের গতি কমলেও একটি ইতিবাচক দিক হলো, প্রতিনিয়ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে টাকা জমার পরিমাণ বাড়ছে, বাড়ছে বিনিয়োগের পরিমাণও! ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করা অর্থ চাঁদা বাবদ জমা পড়া অর্থের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা – এই চারটি স্কিমে ইতোমধ্যে ৩ লাখ ৭৪ হাজারের বেশি মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দিয়েছেন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৮৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার কিছু বেশি।
আর এর বিপরীতে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে সরকারি বিভিন্ন ট্রেজারি বন্ড ও বিলে ইতোমধ্যে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ, চাঁদা বাবদ যে অর্থ জমা পড়েছে, বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে প্রায় চার কোটি টাকার কিছু বেশি। জমা হওয়া চাঁদার চেয়ে বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণ হলো – সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করে যে মুনাফা পাওয়া গেছে, সেই অর্থও আবার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটি স্কিমের আর্থিক সক্ষমতার একটি ইতিবাচক দিক।
সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে সরকার। ওই বছরের ১৭ আগস্ট এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় এবং সেদিন থেকেই আবেদন শুরু হয়।
পরবর্তী সময়ে, সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, শিক্ষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা হয়। বর্তমানে সেই চারটি স্কিম চালু রয়েছে: প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা।
শুরুতে সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও, মাঝে নিবন্ধনে কিছুটা ধীরগতি আসে। তবে গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে হঠাৎ করেই নিবন্ধন করে চাঁদা জমা দেওয়া মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। এপ্রিলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করেন। এতে ওই মাসেই সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধনের সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করে।
অর্থাৎ, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর আট মাস পরে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখ স্পর্শ করে। এরপর মে ও জুন মাসেও বিপুল সংখ্যক মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দেন। এতে জুলাই মাস শুরু হতেই নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ হয়ে যায়, আর জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
কিন্তু এরপরই আসে বড় পরিবর্তন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি বেশ কমে যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর ইতোমধ্যে প্রায় ১১ মাস হয়ে গেছে। অবশ্য শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই। ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি কমতে থাকে, যা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবকে তুলে ধরে।
পরিসংখ্যানগুলো আরও বিস্তারিতভাবে দেখলে বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা গুরুতর। গত বছরের ২ জুলাই দুপুর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছিলেন ৩ লাখ ৪০ হাজার ২৪২ জন। আর তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ৮০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকায় সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়।
দুই মাস পর, ৯ সেপ্টেম্বর, নিবন্ধন সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৪ জন, আর চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর পর দুই মাসে (৩ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নতুন নিবন্ধন সম্পন্ন করেন মাত্র ৩১ হাজার ৮৫২ জন। এরপর নিবন্ধনের হার আরও কমে যায়।
সবশেষ চলতি বছরের ২৪ জুন দুপুর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমাদানকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৭ জন। অর্থাৎ, শেষ সাড়ে নয় মাসে মাত্র ১ হাজার ৯৬৩ জন নতুন নিবন্ধন করেছেন! এর মধ্যে শেষ সাড়ে তিন মাসে নিবন্ধন করেছেন মাত্র ৬৯৬ জন। এটি সত্যিই ‘কচ্ছপগতি’।
সব মিলিয়ে, প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা – এই চার স্কিমে মোট ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৭ জন নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দিয়েছেন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৮৫ কোটি ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা। আর সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও বিলে ১৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, “সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার কিছু বেশি চাঁদা জমা পড়েছে এবং বিনিয়োগ করা হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা। জমা পড়া চাঁদার চেয়ে বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণ – বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা হয়েছে, সেই অর্থও বিনিয়োগ করা হয়েছে।”