ঢাকা ০১:৪৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫

    কেটু মিজান ও তার স্ত্রী গোলাপীর অপরাধ সাম্রাজ্যের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত

    নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
    • আপডেট সময় ১২:০৩:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫
    • / ২৫৮ বার পড়া হয়েছে

    ভয়ংকর অপরাধ জগতের অন্যতম শীর্ষ চরিত্র কেটু মিজান। দিন যত গড়িয়েছে, ততই হিংস্র হয়ে উঠেছেন তিনি। গ্রেপ্তারের পরও তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থামেনি। গতকাল শনিবার পুলিশের কড়া পাহারায় ও পিছমোড়া হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় আদালতে নেওয়ার সময় উপস্থিতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, *“আপনারা নাটক-সিনেমা করেন, আমি করি রিয়েল।”* গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে গলা কেটে হত্যার পরও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখা যায়নি। বরং আদালতে নেওয়ার পথে সাংবাদিকদের চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিয়েছেন তিনি।

    জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার সিঁড়িঘাট মিলন বাজার এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে মিজান প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে পরিবারসহ চলে যান রংপুরে। পরবর্তীতে একই এলাকার মো. সুলাইমানের মেয়ে পারুল আক্তার গোলাপীকে বিয়ে করে গাজীপুরে স্থায়ী হন। সেখানেই গড়ে তোলেন একটি ভয়ংকর অপরাধ সাম্রাজ্য, যার দ্বিতীয় নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর স্ত্রী গোলাপী। দুজন মিলে গাজীপুর মহানগরের ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের নিয়ন্ত্রণ নেন। প্রতিদিন লাখো মানুষের চলাচল করা এই এলাকায় গোলাপী প্রতারণার ফাঁদ (হানিট্র্যাপ) পেতে যুবকদের সর্বস্ব লুটে নিতেন।

    তুহিন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন এ চক্রের সদস্যরা—পাবনার স্বাধীন (২৮), খুলনার আল আমিন (২১), কুমিল্লার শাহ জালাল (৩২), পাবনার ফয়সাল হাসান (২৩), শেরপুরের সাব্বির সুমন (২৬) এবং ময়মনসিংহের শহীদুল ইসলাম। ইতোমধ্যেই তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ জানায়, এই গ্রুপের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইসহ ২৯টি মামলা রয়েছে; এর মধ্যে মিজান একাই ১৫ মামলার আসামি।

    ঘটনার সূত্রপাত হয় গত বৃহস্পতিবার রাতে। শেরপুরের বাদশা মিয়া স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলেন। বিষয়টি নজরে পড়ে গোলাপীর, যিনি তাঁকে হানিট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাদশা বিষয়টি টের পেয়ে গোলাপীকে ঘুষি মারেন। সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে ওত পেতে থাকা সহযোগীরা চাপাতি দিয়ে বাদশাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। এ দৃশ্য ধারণ করছিলেন দৈনিক *প্রতিদিনের কাগজ*–এর স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিন। ভিডিও ধারণ করতে দেখে দুর্বৃত্তরা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চা স্টলে আশ্রয় নেওয়া তুহিনকে টেনে এনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করে তারা।

    গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান জানান, ঘটনার পরপরই সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‍্যাব-১ আলাদা অভিযানে স্বাধীনকে আটক করে। পুলিশ কমিশনার স্বীকার করেন, তুহিন হত্যায় যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় তাদের ব্যর্থতা রয়েছে এবং জনবল স্বল্পতাও সমস্যা তৈরি করেছে।

    বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে—একটি নিহত তুহিনের ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে, অন্যটি বাদশা মিয়ার ভাইয়ের করা। গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে পাঠানো হলে প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়।

    এদিকে কিশোরগঞ্জের ইটনা বাজার থেকে শহীদুল ইসলাম নামে আরও এক আসামিকে র‍্যাব-১৪ গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-১–এর কাছে হস্তান্তর করেছে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে। সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরনের নৃশংসতা শুধু একজন সাংবাদিকের জীবনই কেড়ে নেয়নি, বরং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে।

    এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড গাজীপুরের অপরাধ জগতের এক ভয়ংকর চিত্র উন্মোচন করেছে—যেখানে সংঘবদ্ধ চক্র, প্রতারণা, হানিট্র্যাপ ও প্রকাশ্যে হত্যার মতো অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে চললেও থামানোর কার্যকর ব্যবস্থা ছিল না। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেবে, যাতে তুহিনের মতো আর কোনো সাংবাদিককে প্রাণ হারাতে না হয়।

    নিউজটি শেয়ার করুন

    কেটু মিজান ও তার স্ত্রী গোলাপীর অপরাধ সাম্রাজ্যের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত

    আপডেট সময় ১২:০৩:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫

    ভয়ংকর অপরাধ জগতের অন্যতম শীর্ষ চরিত্র কেটু মিজান। দিন যত গড়িয়েছে, ততই হিংস্র হয়ে উঠেছেন তিনি। গ্রেপ্তারের পরও তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থামেনি। গতকাল শনিবার পুলিশের কড়া পাহারায় ও পিছমোড়া হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় আদালতে নেওয়ার সময় উপস্থিতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, *“আপনারা নাটক-সিনেমা করেন, আমি করি রিয়েল।”* গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে গলা কেটে হত্যার পরও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখা যায়নি। বরং আদালতে নেওয়ার পথে সাংবাদিকদের চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিয়েছেন তিনি।

    জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার সিঁড়িঘাট মিলন বাজার এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে মিজান প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে পরিবারসহ চলে যান রংপুরে। পরবর্তীতে একই এলাকার মো. সুলাইমানের মেয়ে পারুল আক্তার গোলাপীকে বিয়ে করে গাজীপুরে স্থায়ী হন। সেখানেই গড়ে তোলেন একটি ভয়ংকর অপরাধ সাম্রাজ্য, যার দ্বিতীয় নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর স্ত্রী গোলাপী। দুজন মিলে গাজীপুর মহানগরের ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের নিয়ন্ত্রণ নেন। প্রতিদিন লাখো মানুষের চলাচল করা এই এলাকায় গোলাপী প্রতারণার ফাঁদ (হানিট্র্যাপ) পেতে যুবকদের সর্বস্ব লুটে নিতেন।

    তুহিন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন এ চক্রের সদস্যরা—পাবনার স্বাধীন (২৮), খুলনার আল আমিন (২১), কুমিল্লার শাহ জালাল (৩২), পাবনার ফয়সাল হাসান (২৩), শেরপুরের সাব্বির সুমন (২৬) এবং ময়মনসিংহের শহীদুল ইসলাম। ইতোমধ্যেই তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ জানায়, এই গ্রুপের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইসহ ২৯টি মামলা রয়েছে; এর মধ্যে মিজান একাই ১৫ মামলার আসামি।

    ঘটনার সূত্রপাত হয় গত বৃহস্পতিবার রাতে। শেরপুরের বাদশা মিয়া স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলেন। বিষয়টি নজরে পড়ে গোলাপীর, যিনি তাঁকে হানিট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাদশা বিষয়টি টের পেয়ে গোলাপীকে ঘুষি মারেন। সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে ওত পেতে থাকা সহযোগীরা চাপাতি দিয়ে বাদশাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। এ দৃশ্য ধারণ করছিলেন দৈনিক *প্রতিদিনের কাগজ*–এর স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিন। ভিডিও ধারণ করতে দেখে দুর্বৃত্তরা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চা স্টলে আশ্রয় নেওয়া তুহিনকে টেনে এনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করে তারা।

    গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান জানান, ঘটনার পরপরই সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‍্যাব-১ আলাদা অভিযানে স্বাধীনকে আটক করে। পুলিশ কমিশনার স্বীকার করেন, তুহিন হত্যায় যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় তাদের ব্যর্থতা রয়েছে এবং জনবল স্বল্পতাও সমস্যা তৈরি করেছে।

    বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে—একটি নিহত তুহিনের ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে, অন্যটি বাদশা মিয়ার ভাইয়ের করা। গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে পাঠানো হলে প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়।

    এদিকে কিশোরগঞ্জের ইটনা বাজার থেকে শহীদুল ইসলাম নামে আরও এক আসামিকে র‍্যাব-১৪ গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-১–এর কাছে হস্তান্তর করেছে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে। সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরনের নৃশংসতা শুধু একজন সাংবাদিকের জীবনই কেড়ে নেয়নি, বরং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে।

    এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড গাজীপুরের অপরাধ জগতের এক ভয়ংকর চিত্র উন্মোচন করেছে—যেখানে সংঘবদ্ধ চক্র, প্রতারণা, হানিট্র্যাপ ও প্রকাশ্যে হত্যার মতো অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে চললেও থামানোর কার্যকর ব্যবস্থা ছিল না। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেবে, যাতে তুহিনের মতো আর কোনো সাংবাদিককে প্রাণ হারাতে না হয়।