ঢাকা ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫

সৌদি আরবের গোপন ‘কারাগার’: ‘অবাধ্য নারীদের’ ভাগ্যে কী ঘটে?

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
  • আপডেট সময় ০৪:৫৯:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
  • / ২৬৫ বার পড়া হয়েছে

সম্প্রতি সৌদি আরবে একটি ছবি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কালো বোরকায় ঢাকা এক নারী একটি বহুতল ভবনের দোতলার কার্নিশে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, আর দ্বিতীয় আরেকটি ছবিতে ক্রেনের সাহায্যে তাকে নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে।

এই ছবিটি সৌদির কুখ্যাত গোপন ‘কারাগার’ বা ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’গুলোর ভেতরের এক ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যদিও ওই নারীর পরিচয় জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি সৌদি আরবের সেইসব ‘অবাধ্য’ নারীদের একজন, যাদের পরিবার বা স্বামীর অবাধ্য হলে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ালে বা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়।

সরকারিভাবে এগুলোকে ‘দার আল-রেয়া’ বা ‘পরিচর্যা কেন্দ্র’ বলা হলেও, মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এগুলি আদতে গোপন কারাগার।

গার্ডিয়ান পত্রিকার ছয় মাসের বেশি সময়ের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কেন্দ্রে নারীদের নিয়মিত মারধর করা হয়, জোর করে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় এবং বাইরের জগতের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে দেওয়া হয় না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, বেশ কয়েকজন নারী সেখানে আত্মহত্যা করেছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

এই কেন্দ্রগুলোতে নারীদের বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয় এবং পরিবার বা একজন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাদের বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সৌদি আরবের এক তরুণীর ভাষ্যমতে, ‘সৌদি আরবে বড় হওয়া প্রত্যেক মেয়ে দার আল-রেয়ার কথা এবং সেখানকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা জানে। এটি যেন এক নরক।’

তিনি নিজেও সেখানে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং পরে পালিয়ে নির্বাসনে চলে যান। লন্ডনভিত্তিক সৌদি আরবের অধিকারকর্মী মরিয়ম আলদোসারি বলেন, ‘একজন তরুণী বা নারী যতদিন পর্যন্ত নিয়মকানুন মেনে চলার কথা স্বীকার না করবেন, ততদিন তাকে সেখানে থাকতে হবে।’

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সারাহ আল-ইয়াহিয়া এই কেন্দ্রগুলোকে ‘কারাগার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, সেখানে বন্দীদের নাম ধরে নয়, বরং নম্বর অনুযায়ী ডাকা হয়, যেমন – ‘নম্বর ৩৫, এখানে আসো!’

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়। কর্মকর্তারা দাবি করেন, এগুলো অপরাধে অভিযুক্ত তরুণীদের আশ্রয়স্থল, যেখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তাদের পুনর্বাসন করা হয়। তবে সারাহ আল-ইয়াহিয়া, যিনি এই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার দাবিতে প্রচারণা চালাচ্ছেন, জানান, সেখানে বন্দীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।

কেন্দ্রে আসার সময়ই তাদের নগ্ন করে শরীর তল্লাশি ও কৌমার্য পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়, এবং তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে ওষুধ দেওয়া হয়। এমনকি ধর্মীয় অনুশাসন না মানলে বা সমকামী সন্দেহেও বেত্রাঘাত করা হয়।

সারাহ, যিনি এখন নির্বাসনে আছেন, দাবি করেন, তার ১৩ বছর বয়সে তার বাবা তাকে দার আল-রেয়ায় পাঠানোর হুমকি দিতেন, যদি তিনি তার বাবার যৌন নিপীড়ন মেনে না নিতেন।

তিনি আরও বলেন, সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নারীদের সাহায্য করাও অপরাধ। যদি কোনো নারীকে কেউ আশ্রয় দেন, সেটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধিকারকর্মী বলেন, ‘এসব নারীর শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে কেউ থাকেন না। বছরের পর বছর তারা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন, এমনকি তারা যদি কোনো অপরাধ না করেন, তবু। কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ একজন পুরুষ অভিভাবক, বিয়ে করা অথবা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া।’

দুঃখজনকভাবে, কিছু বয়স্ক পুরুষ বা অপরাধী হিসেবে সাজা ভোগ করা ব্যক্তি, যাদের কেউ বিয়ে করতে চান না, তারা এসব কেন্দ্রে এসে পাত্রী খোঁজেন। কেউ কেউ এই নরক থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে তাদের বিয়ে করতে রাজিও হন।

তবে, সৌদি সরকারের একজন মুখপাত্র এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কেন্দ্রগুলো পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তা করে এবং এগুলো কারাগার নয়। তার দাবি, নারীরা যেকোনো সময় এখান থেকে বের হতে পারেন এবং পরিবার বা অভিভাবকের অনুমোদন ছাড়াই স্থায়ীভাবে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

সৌদি আরবের গোপন ‘কারাগার’: ‘অবাধ্য নারীদের’ ভাগ্যে কী ঘটে?

আপডেট সময় ০৪:৫৯:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

সম্প্রতি সৌদি আরবে একটি ছবি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কালো বোরকায় ঢাকা এক নারী একটি বহুতল ভবনের দোতলার কার্নিশে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, আর দ্বিতীয় আরেকটি ছবিতে ক্রেনের সাহায্যে তাকে নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে।

এই ছবিটি সৌদির কুখ্যাত গোপন ‘কারাগার’ বা ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’গুলোর ভেতরের এক ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যদিও ওই নারীর পরিচয় জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি সৌদি আরবের সেইসব ‘অবাধ্য’ নারীদের একজন, যাদের পরিবার বা স্বামীর অবাধ্য হলে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ালে বা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়।

সরকারিভাবে এগুলোকে ‘দার আল-রেয়া’ বা ‘পরিচর্যা কেন্দ্র’ বলা হলেও, মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এগুলি আদতে গোপন কারাগার।

গার্ডিয়ান পত্রিকার ছয় মাসের বেশি সময়ের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কেন্দ্রে নারীদের নিয়মিত মারধর করা হয়, জোর করে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় এবং বাইরের জগতের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে দেওয়া হয় না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, বেশ কয়েকজন নারী সেখানে আত্মহত্যা করেছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

এই কেন্দ্রগুলোতে নারীদের বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয় এবং পরিবার বা একজন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাদের বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সৌদি আরবের এক তরুণীর ভাষ্যমতে, ‘সৌদি আরবে বড় হওয়া প্রত্যেক মেয়ে দার আল-রেয়ার কথা এবং সেখানকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা জানে। এটি যেন এক নরক।’

তিনি নিজেও সেখানে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং পরে পালিয়ে নির্বাসনে চলে যান। লন্ডনভিত্তিক সৌদি আরবের অধিকারকর্মী মরিয়ম আলদোসারি বলেন, ‘একজন তরুণী বা নারী যতদিন পর্যন্ত নিয়মকানুন মেনে চলার কথা স্বীকার না করবেন, ততদিন তাকে সেখানে থাকতে হবে।’

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সারাহ আল-ইয়াহিয়া এই কেন্দ্রগুলোকে ‘কারাগার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, সেখানে বন্দীদের নাম ধরে নয়, বরং নম্বর অনুযায়ী ডাকা হয়, যেমন – ‘নম্বর ৩৫, এখানে আসো!’

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়। কর্মকর্তারা দাবি করেন, এগুলো অপরাধে অভিযুক্ত তরুণীদের আশ্রয়স্থল, যেখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তাদের পুনর্বাসন করা হয়। তবে সারাহ আল-ইয়াহিয়া, যিনি এই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার দাবিতে প্রচারণা চালাচ্ছেন, জানান, সেখানে বন্দীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।

কেন্দ্রে আসার সময়ই তাদের নগ্ন করে শরীর তল্লাশি ও কৌমার্য পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়, এবং তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে ওষুধ দেওয়া হয়। এমনকি ধর্মীয় অনুশাসন না মানলে বা সমকামী সন্দেহেও বেত্রাঘাত করা হয়।

সারাহ, যিনি এখন নির্বাসনে আছেন, দাবি করেন, তার ১৩ বছর বয়সে তার বাবা তাকে দার আল-রেয়ায় পাঠানোর হুমকি দিতেন, যদি তিনি তার বাবার যৌন নিপীড়ন মেনে না নিতেন।

তিনি আরও বলেন, সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নারীদের সাহায্য করাও অপরাধ। যদি কোনো নারীকে কেউ আশ্রয় দেন, সেটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধিকারকর্মী বলেন, ‘এসব নারীর শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে কেউ থাকেন না। বছরের পর বছর তারা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন, এমনকি তারা যদি কোনো অপরাধ না করেন, তবু। কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ একজন পুরুষ অভিভাবক, বিয়ে করা অথবা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া।’

দুঃখজনকভাবে, কিছু বয়স্ক পুরুষ বা অপরাধী হিসেবে সাজা ভোগ করা ব্যক্তি, যাদের কেউ বিয়ে করতে চান না, তারা এসব কেন্দ্রে এসে পাত্রী খোঁজেন। কেউ কেউ এই নরক থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে তাদের বিয়ে করতে রাজিও হন।

তবে, সৌদি সরকারের একজন মুখপাত্র এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কেন্দ্রগুলো পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তা করে এবং এগুলো কারাগার নয়। তার দাবি, নারীরা যেকোনো সময় এখান থেকে বের হতে পারেন এবং পরিবার বা অভিভাবকের অনুমোদন ছাড়াই স্থায়ীভাবে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখেন।