বাংলাদেশ শ্রীলংকা নেপালের পর এবার ভারত নিয়ে দুশ্চিন্তায় মোদি সরকার

- আপডেট সময় ১২:৩৬:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৬১ বার পড়া হয়েছে
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সহিংস বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির পতন ঘটেছে। ভারতের কৌশলগত প্রতিবেশী এই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে দিল্লি। পরিস্থিতি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সংকটকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংস বিক্ষোভে সরকারের পতন ঘটানো তৃতীয় দেশ হলো ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী নেপাল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর প্রধানমন্ত্রী ওলি পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালায় এবং কয়েকজন রাজনীতিকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। কাঠমান্ডুর এই পরিস্থিতি গত বছরের বাংলাদেশ ও ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতার দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেককে।
যদিও বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, নেপালের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার উন্মুক্ত সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে ভারত ও নেপাল, যা মূলত উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। ফলে সীমান্তবর্তী অস্থিরতা ভারতের অভ্যন্তরেও প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে ভারতে প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি নাগরিক বসবাস ও কাজ করছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে গভীর পারিবারিক সম্পর্ক ও অবাধ যাতায়াত ব্যবস্থা। ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই নেপালি নাগরিকরা ভারতে প্রবেশ ও কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারেন। একই সঙ্গে বিশেষ চুক্তির আওতায় নেপালের প্রায় ৩২ হাজার গুর্খা সেনা বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক নিবিড়। বছরে প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়, যেখানে তেল ও খাদ্যপণ্যের জন্য কাঠমান্ডু ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপালের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, “নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। এত তরুণ প্রাণহানিতে আমি মর্মাহত। নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।” মোদি ইতোমধ্যেই মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের সময় যেমন ভারত অপ্রস্তুত ছিল, নেপালের অস্থিরতাও তাদের বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে ওলির দিল্লি সফরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার পদত্যাগ ঘটনাটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।
চীন ও ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নেপালের অবস্থান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড নেপালের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থান করছে, অন্যদিকে ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ পথও নেপালের ভেতর দিয়ে গেছে। ফলে নেপালের অস্থিরতা ভারতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত এখন অত্যন্ত সতর্ক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
তবে নেপালের পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে, কারণ বিক্ষোভকারীরা প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ওলির নেতৃত্বাধীন সিপিএন-ইউএমএল, শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস এবং পুষ্পকমল দাহালের নেতৃত্বাধীন সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) — কোনো দলই তাদের আস্থা পাচ্ছে না। এ অবস্থায় ওলির উত্তরসূরী কী ধরনের সরকার গঠন করবেন, তা স্পষ্ট নয়।
২০১৯ সালে ভারতের নতুন মানচিত্রে বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করায় নেপাল ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং পাল্টা মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। সম্প্রতি ভারত ও চীন সেই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যার বিরোধিতা করেছিলেন ওলি। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের উচিত নেপালের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মকে পাশে টানা। শিক্ষাবৃত্তি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) দীর্ঘদিন অকার্যকর থাকায় ভারতের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর অস্থিরতা মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে এবং মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এ অবস্থায় ভারতের ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।