০১:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৩ মে ২০২৫

কারাগারে ভিআইপি বন্দি: ডিভিশন সুবিধার ভেতরের কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা
  • আপডেট সময় ০২:২২:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫
  • / ৪ বার পড়া হয়েছে

কারাগার, যেখানে সাধারণ অপরাধীরা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেন, সেখানে কিছু বন্দি পান বিশেষ সুবিধা। আদালতের নির্দেশে অথবা কারাবিধি অনুযায়ী, সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের ভিত্তিতে কিছু বন্দিকে দেওয়া হয় ‘ডিভিশন’। কিন্তু এই ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিরা ঠিক কী কী বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন জানান, কারাবিধি এবং আদালতের নির্দেশ মেনেই বন্দিদের ডিভিশন দেওয়া হয়।

তবে, কারাগারে সিঙ্গেল রুমসহ ডিভিশনপ্রাপ্তদের জন্য নির্দিষ্ট সুবিধা রয়েছে। একই ধরনের ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য বন্দির সংখ্যা বেশি হলে, তখন সবাইকে সেই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না।

কারা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি সবসময়ই এসব কারাগারে অবস্থান করেন। গত মাসের হিসাব অনুযায়ী, ৪২ হাজার ৮৭৭ জনের ধারণক্ষমতার বিপরীতে কারাগারে বন্দি ছিলেন ৭০ হাজারের বেশি মানুষ।

কারাবিধি অনুযায়ী, বন্দিদের মূলত তিনটি ডিভিশনে ভাগ করা হয়: ডিভিশন-১, ডিভিশন-২ এবং ডিভিশন-৩।

ডিভিশন-১ এর জন্য কারা বিবেচিত হন? বিধি অনুযায়ী, ভালো চরিত্রের অধিকারী, অভ্যাসবশত অপরাধী নন, সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, শিক্ষিত এবং উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত বন্দিরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হন।

বিশেষভাবে, সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সের ১ থেকে ১৮ নম্বর অবস্থানে থাকা প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সুবিধা পান।

এছাড়াও, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তি, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকজয়ী, বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সিআইপি এবং প্রফেসর ইমেরিটাস পদে নিযুক্ত ব্যক্তিরাও ডিভিশন-১ এর সুবিধা লাভ করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময়ে সময়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আরও কিছু ব্যক্তিকে এই সুবিধা দিতে পারে।

অন্যদিকে, নাগরিকত্ব নির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার ধরনের ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য উচ্চমানের বন্দিরা ডিভিশন-২ পাওয়ার যোগ্য হন।

কারা বিধি অনুযায়ী, বন্দির নিযুক্ত আইনজীবী বা আত্মীয়-স্বজনকেই এই বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে হয়। তথ্যের ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ থাকলে, কারা কর্তৃপক্ষ প্রথমে বন্দিকে ডিভিশন দেয় এবং পরে বিষয়টি সরকারের কাছে পাঠায়।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা সাধারণ বন্দিদের থেকে আলাদা কী কী সুবিধা পান? সাধারণত, গ্রেফতারের পর জামিন না পেলে বিচারাধীন বন্দিদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা কারাগারে ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে খাটসহ একটি সিঙ্গেল রুম পান।

শুধু তাই নয়, তাদের খাবারের মেন্যু ও পরিমাণেও ভিন্নতা থাকে। তারা পান পত্রিকা, চেয়ার, টেবিল, তোষক, বালিশ, তেল, চিরুনি ও আয়নার মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এমনকি, বিশেষ অনুমতি নিয়ে তারা অফিস রুমে তাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগও পান।

ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিদের কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য একজন সহকারী বন্দিও দেওয়া হয়। পুরুষ বন্দিদের জন্য একজন ছেলে এবং নারী বন্দিদের জন্য একজন মেয়ে বন্দি এই দায়িত্ব পালন করেন।

পাশাপাশি, তারা একটি পত্রিকা ও বই পড়ার সুযোগও পান, যা সাধারণ বন্দিদের জন্য কেবল সাক্ষাৎ রুমেই সীমাবদ্ধ থাকে।

গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গ্রেফতার হওয়া অনেক প্রাক্তন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এই ডিভিশন সুবিধা পেয়েছেন। তবে, কিছু প্রাক্তন এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ মোতাহের হোসেন গত মাসে জানিয়েছিলেন, তখন পর্যন্ত ১৫১ জন প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন, যার মধ্যে ছিলেন ৩০ জন প্রাক্তন মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, ৩৮ জন প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং ৭০ জন সরকারি কর্মকর্তা।

তবে, অন্তত ২৪ জন প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা বন্দি থাকা সত্ত্বেও সেই সুবিধা পাননি।

কারা কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কারাগারে সুবিধা খালি থাকা সাপেক্ষেই সাধারণত ডিভিশন দেওয়া হয়। ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য বন্দির সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে, তখন সবাইকে এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

কারাগারে ভিআইপি বন্দি: ডিভিশন সুবিধার ভেতরের কথা

আপডেট সময় ০২:২২:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫

কারাগার, যেখানে সাধারণ অপরাধীরা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেন, সেখানে কিছু বন্দি পান বিশেষ সুবিধা। আদালতের নির্দেশে অথবা কারাবিধি অনুযায়ী, সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের ভিত্তিতে কিছু বন্দিকে দেওয়া হয় ‘ডিভিশন’। কিন্তু এই ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিরা ঠিক কী কী বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন জানান, কারাবিধি এবং আদালতের নির্দেশ মেনেই বন্দিদের ডিভিশন দেওয়া হয়।

তবে, কারাগারে সিঙ্গেল রুমসহ ডিভিশনপ্রাপ্তদের জন্য নির্দিষ্ট সুবিধা রয়েছে। একই ধরনের ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য বন্দির সংখ্যা বেশি হলে, তখন সবাইকে সেই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না।

কারা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি সবসময়ই এসব কারাগারে অবস্থান করেন। গত মাসের হিসাব অনুযায়ী, ৪২ হাজার ৮৭৭ জনের ধারণক্ষমতার বিপরীতে কারাগারে বন্দি ছিলেন ৭০ হাজারের বেশি মানুষ।

কারাবিধি অনুযায়ী, বন্দিদের মূলত তিনটি ডিভিশনে ভাগ করা হয়: ডিভিশন-১, ডিভিশন-২ এবং ডিভিশন-৩।

ডিভিশন-১ এর জন্য কারা বিবেচিত হন? বিধি অনুযায়ী, ভালো চরিত্রের অধিকারী, অভ্যাসবশত অপরাধী নন, সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, শিক্ষিত এবং উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত বন্দিরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হন।

বিশেষভাবে, সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সের ১ থেকে ১৮ নম্বর অবস্থানে থাকা প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সুবিধা পান।

এছাড়াও, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তি, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকজয়ী, বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সিআইপি এবং প্রফেসর ইমেরিটাস পদে নিযুক্ত ব্যক্তিরাও ডিভিশন-১ এর সুবিধা লাভ করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময়ে সময়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আরও কিছু ব্যক্তিকে এই সুবিধা দিতে পারে।

অন্যদিকে, নাগরিকত্ব নির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার ধরনের ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য উচ্চমানের বন্দিরা ডিভিশন-২ পাওয়ার যোগ্য হন।

কারা বিধি অনুযায়ী, বন্দির নিযুক্ত আইনজীবী বা আত্মীয়-স্বজনকেই এই বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে হয়। তথ্যের ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ থাকলে, কারা কর্তৃপক্ষ প্রথমে বন্দিকে ডিভিশন দেয় এবং পরে বিষয়টি সরকারের কাছে পাঠায়।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা সাধারণ বন্দিদের থেকে আলাদা কী কী সুবিধা পান? সাধারণত, গ্রেফতারের পর জামিন না পেলে বিচারাধীন বন্দিদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা কারাগারে ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে খাটসহ একটি সিঙ্গেল রুম পান।

শুধু তাই নয়, তাদের খাবারের মেন্যু ও পরিমাণেও ভিন্নতা থাকে। তারা পান পত্রিকা, চেয়ার, টেবিল, তোষক, বালিশ, তেল, চিরুনি ও আয়নার মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এমনকি, বিশেষ অনুমতি নিয়ে তারা অফিস রুমে তাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগও পান।

ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিদের কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য একজন সহকারী বন্দিও দেওয়া হয়। পুরুষ বন্দিদের জন্য একজন ছেলে এবং নারী বন্দিদের জন্য একজন মেয়ে বন্দি এই দায়িত্ব পালন করেন।

পাশাপাশি, তারা একটি পত্রিকা ও বই পড়ার সুযোগও পান, যা সাধারণ বন্দিদের জন্য কেবল সাক্ষাৎ রুমেই সীমাবদ্ধ থাকে।

গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গ্রেফতার হওয়া অনেক প্রাক্তন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এই ডিভিশন সুবিধা পেয়েছেন। তবে, কিছু প্রাক্তন এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ মোতাহের হোসেন গত মাসে জানিয়েছিলেন, তখন পর্যন্ত ১৫১ জন প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন, যার মধ্যে ছিলেন ৩০ জন প্রাক্তন মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, ৩৮ জন প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং ৭০ জন সরকারি কর্মকর্তা।

তবে, অন্তত ২৪ জন প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা বন্দি থাকা সত্ত্বেও সেই সুবিধা পাননি।

কারা কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কারাগারে সুবিধা খালি থাকা সাপেক্ষেই সাধারণত ডিভিশন দেওয়া হয়। ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য বন্দির সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে, তখন সবাইকে এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না